নিয়তি নাকি ট্র্যাজেডি!

আফ্রিকা মহাদেশের ক্রিকেট, এমনিতেই যেন কোথাও একটা মাদকতা কাজ করে, সে দক্ষিণ প্রান্তের দেশটার অ্যালান ডোনাল্ড, জন্টি রোডস, জ্যাক ক্যালিস, ল্যান্স ক্লুজনাররা কিংবা মানচিত্রে তার একটু ওপরের দিকে থাকা জিম্বাবোয়ের ফ্লাওয়ার ভাই, নিল জনসন বা হিথ স্ট্রিকরা সেকালে বাইশ গজে নামলে অদ্ভুত এক ক্রিকেট রোমান্সে বুঁদ হয়ে থাকা ছাড়া বোধহয় উপায় থাকতো না।

সেই আফ্রিকার আরেক ঝলক টাটকা বাতাস হয়ে আসা স্টিভ টিকোলো, কলিন্স ওবুয়া, থমাস ওদোয়ো, মরিস ওদুম্বে, মার্টিন সুজিদের নিশ্চয়ই মনে আছে? গত শতকের নয়ের দশকের মাঝামাঝি থেকে যাঁরা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট নিয়মিত ফলো করতেন তাদের মনে থাকারই কথা। হ্যাঁ সেই কেনিয়া, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে বেশ কয়েক বছর যারা যথেষ্ট ছাপ রেখেই গিয়েছিলো।

দৈত্য বধের দুর্বিনীত সাহসী সৈনিক হয়ে সবুজ লাল জার্সিতে বিশ্ব ক্রিকেটে নতুন রোমান্স ছড়ানো কেনিয়া নিয়েই আজ যত গল্প। যাদের মনে করা হচ্ছিলো পরবর্তী টেস্ট স্ট্যাটাস পেতে চলা দল, কালের গর্ভে তারাই আজ প্রায় বিস্মৃত।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কেনিয়ার প্রথম আত্মপ্রকাশ ১৯৯৬ এর বিশ্বকাপ ক্রিকেটে। ১৯৯৪ সালের আইসিসি ট্রফি জিতে বিশ্বকাপে খেলতে আসা আরেক অ্যাসোসিয়েট দল সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এর সাথে। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচই কেনিয়ার, আয়োজক ভারতের সাথে কটকের বরবটি স্টেডিয়ামে, প্রথম ম্যাচ ভারতের কাছে হারলেও সেই ম্যাচেই উদয় পরবর্তী ১৫ বছরের অ্যাসোসিয়েট দেশ গুলির সেরা ব্যাটসম্যান স্টিভ টিকোলোর।

৬৫ করেছিলেন সে ম্যাচে, শচীন টেন্ডুলকারের সেঞ্চুরিতে যদিও ম্যাচে জেতে ভারত। বহু বছর কেনিয়া ক্রিকেটের ব্যাটিং এর ‘একা কুম্ভ’ ছিলেন বলা যায়। কেনিয়া ক্রিকেটের সর্বকালের অবিসংবাদিত ভাবে সেরা ব্যাটসম্যান ছিলেন এই টিকোলো। শুধু ব্যাট হাতে নয়, বল হাতেও দলের অন্যতম সেরা ভরসা ছিলেন তিনিই। বড়ো দলের বিরুদ্ধে ম্যাচে বহুবারই ঝলসে উঠেছেন তিনিই অলরাউন্ড পারফরমেন্স দিয়ে।

সেই ১৯৯৬ বিশ্বকাপেই শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ৯৬ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেছিলেন টিকোলো, পরের ১৯৯৯, ২০০৩ কিংবা ২০০৭ সমস্ত বিশ্বকাপেই ব্যাটে বলে দলের অন্যতম সেরা পারফর্মার ছিলেন টিকোলোই। এছাড়া সতীর্থ দের কাছে ‘গানজি’ নামে জনপ্রিয় এই টিকোলোর নেতৃত্বেই ২০০৩ বিশ্বকাপের সেমিফাইনাল খেলে কেনিয়া।

যাই হোক, সেবার ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে পদার্পন করার ১১ দিনের মাথাতেই বিশাল অঘটন ঘটালো কেনিয়া, শক্তিশালী ওয়েস্ট ইন্ডিজকে পুনেতে ৯৩ রানে অল আউট করে ৭৩ রানে ম্যাচ জিতলো এই নব্য দলটি, ম্যাচের নায়ক বহু যুদ্ধের ঘোড়া মরিস ওদুম্বে আর তার সাথে রজব আলী। এই একটা বড়ো জয়ই কেনিয়া কে নিয়মিত একদিনের ম্যাচে খেলার সুযোগ করে দিলো আইসিসি।

অনেকেরই হয়তো মনে নেই ১৯৯৮ সালে ভারত, বাংলাদেশ আর কেনিয়া কে নিয়ে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ হয়েছিল, যার ফাইনালে ইডেন গার্ডেন্স এ ভারতের মুখোমুখি হয়েছিল কেনিয়া, কেনিয়া হারলেও প্রশংসা পেয়েছিলো তাদের লড়াই, দারুন ব্যাট করেছিলেন হিতেশ মোদী নামে এক বাঁহাতি স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান।

এই হিতেশ মোদীই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র ক্রিকেটার  আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে নিজের বাবার আম্পয়ারিং এর দ্বারা আউট হন, সেটা ২০০৬ সালে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এক ওয়ানডেতে, উল্টো দিকে আম্পায়ার ছিলেন ‘বাবা’ সুভাষ মোদী। যাই হোক সেই ১৯৯৮ সালের ভারতে হওয়া টুর্নামেন্টেই কিন্তু প্রথম বার ওডিআই তে প্রথম বার ভারত কে হারায় কেনিয়া, গোয়ালিয়র ম্যাচে ভারত কে চমকে দেয় তারা, ম্যাচের নায়ক আবারো সেই ওদুম্বে, আর টিকোলো। ব্যাটে বলে দুরন্ত হয়ে উঠেছিলেন সেদিন ভারতের বিরুদ্ধে।

২০০১ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলতে গিয়ে আবারো কেনিয়ার তোপের মুখে পড়ে সেই ভারতই, কেনেডি ওটিয়েনোর দারুন ব্যাটিং এর পরে জোসেফ আঙ্গারা বল হাতে পরাস্ত করেন ভারত কে, সেই ম্যাচে আঙ্গারার শচীনের বিরুদ্ধে স্পেলটা কারোর মনে না থাকলে ইউটিউবে দেখে নিতে পারেন।

এরপর ২০০৩ বিশ্বকাপ, স্বপ্নের উড়ান কেনিয়ার জন্য, নাইরোবির জিমখানা মাঠে সেদিন লেগ স্পিনার কলিন্স ওবুয়ার ওপর কি ভর করেছিল কে জানে, ২৭ রানে ৫ উইকেট নিয়ে জয়সূরিয়া, ডি সিলভা, সাঙ্গাকারা সমৃদ্ধ শ্রীলঙ্কার ব্যাটিং লাইন আপকে দিলেন তছনছ করে, ৫৭ রানে জিতলো কেনিয়া। সেবারে বিশ্বকাপের শুরু থেকেই লম্বা এই লেগস্পিনারকে নিয়ে আলোচনা চলছিল, সেই কলিন্সই এরপর দীর্ঘদিন কেনিয়ার বোলিং শুধু নয় লোয়ার অর্ডার ব্যাটিং এও এক ভরসার নাম ছিলেন।

কেনিয়ার কাছে সেই রূপকথাসম বিশ্বকাপে এরপর নিউজিলান্ড এর বিপক্ষে পয়েন্ট পাওয়া আর কানাডা, বাংলাদেশ, জিম্বাবোয়েকে হারিয়ে কেনিয়া সোজা পৌঁছে যায় সেমি ফাইনালে।টমাস ওদোয়ো, মার্টিন সুজি, কেনেডি ওটিয়েনো, মরিস ওদুম্বেদের নাম তখন সকলের মুখে মুখে।

সেই দলের থমাস ওদোয়ো ছিলেন বছরের পর বছর ধরে দলের অন্যতম সেরা অলরাউন্ডার, মার্টিন সুজির সাথে বোলিং ওপেন করার পাশাপাশি লোয়ার মিডল অর্ডারের সবচেয়ে বড়ো ভরসাই ছিলেন ওদোয়ো, এতটাই প্রতিভাবান অলরাউন্ডার ছিলেন যে ধারাভাষ্যকাররা তাঁর নাম দেন ‘ব্ল্যাক বোথাম’।

কেনেডি ওটিয়েনো যিনি কেনিয়ার উইকেট কিপিং করতেন, দলের ব্যাটিং এও এক বড়ো সম্পদ ছিলেন। রবিন্দু শাহ এর সাথে ওটিয়েনোর ওপেনিং জুটি দীর্ঘদিন কেনিয়াকে ভরসা জুগিয়েছে। সে দলের মিডল অর্ডারে থাকতেন টিকোলো, ওদুম্বে আর হিতেশ মোদীরা। এমন দারুন প্রতিভাবান দল নিয়ে বিশ্বকাপে সেবার প্রথম কোনো নন টেস্ট প্লেয়িং দল হিসাবে সেমিফাইনালে উঠে কিন্তু গোটা ক্রিকেট বিশ্বকে চমকে দিলো কেনিয়া।

সেমি ফাইনালে সৌরভের ভারতের কাছে পরাজয়ে কেনিয়ার স্বপ্নের উড়ানের সমাপ্তি হয়। এর মাঝে সুপার সিক্সে অস্ট্রেলিয়া ম্যাচটার কথা না বললেই নয়, প্রায় অস্তাচলে যাওয়া অবসর ভেঙে ফেরা এক বোলার দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়া কে প্রায় শুইয়ে, হাতে রান কম থাকায় সেদিন জিততে পারেনি কেনিয়া। বোলার হলেন আসিফ করিম, যার সেদিন বোলিং গড় ছিল ৮.২-৩-৭-৩, প্রসঙ্গত সেই আসিফ করিমের ছেলে ইরফান করিম বর্তমান কেনিয়া দলের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান।

এই ২০০৩ বিশ্বকাপের পরেই কেনিয়ার পতন শুরু, ২০০৭ ও ২০১১ বিশ্বকাপ খেললেও বড়ো কোনো ছাপ রাখতে ব্যর্থ তারা। পেরোতে পারেনি আর প্রথম ধাপের গন্ডিও, ২০১১ বিশ্বকাপ শুরুর সময় কেনিয়ার তৎকালীন অধিনায়ক জিমি কামান্ডে বলেছিলেন এক নতুন ব্র্যান্ড এর ক্রিকেট খেলতে চান তারা, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে কলিন্স ওবুয়ার ৯৮* রানের ইনিংস টি বাদ দিলে গোটা বিশ্বকাপে আর কোনো ব্র্যান্ড এর হদিশ পাওয়া যায়নি।

আর পরের ২০১৫ ও ২০১৯ বিশ্বকাপে বা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ গুলিতে তারা যোগ্যতা অর্জনেই ব্যর্থ হয়। শুধু সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবেই যে একটি দেশের সম্ভাবনার ক্রিকেট ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, তার জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ বোধহয় এই কেনিয়াই। কেনিয়ান ক্রিকেটের আজকের দুরবস্থার মূল কারণ দেশটির ক্রিকেট প্রশাসকদের অপরিণামদর্শিতা আর বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ড।

যে দলটিকে একসময় অসম্ভব প্রতিভাসম্পন্ন হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেই দলই ধীরে ধীরে তারকাহীন হয়ে পড়লো। ২০১৪ সালের বিশ্বকাপ কোয়ালিফায়ারের পরে হারালো একদিনের ম্যাচ খেলার স্ট্যাটাস ও।

দেশটির ক্রিকেটের গভীরতা বাড়াতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করেনি কেনিয়ার ক্রিকেট প্রশাসকরা। সুন্দর একটি ভবিষ্যৎকে গলা টিপে মেরে ফেলার এমন উদাহরণ বোধহয় আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেনিয়ার ক্রিকেট আজ তাই নি:স্ব, রিক্ত। কী বলবেন কেনিয়া ক্রিকেটের এই অবস্থাকে? নিয়তি নাকি ট্র্যাজেডি!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link