নিশব্দ বিপ্লবের সুরে লেখা প্রত্যাবর্তন

লোকেশ রাহুল এই রাতে খেলতে নামেননি। নেমেছিলেন যেন কোনও এক নিরব বিপ্লব হয়ে। প্রতিটি শটে বাজছিল, ‘তোমরা বোঝোনি।’ প্রতিটি ছক্কা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল লখনৌর হৃদয়ের গোপন ক্ষত। মঞ্চে দাঁড়িয়ে, এক সুরসম্রাট বলে যাচ্ছিলেন, ‘আমি আছি, থাকব!’

প্রতিপক্ষের মাঠে, ভরা মাহফিল। ভরা  মজলিশকে সুরের মূর্ছনায় ডুবিয়ে, বুকের গভীরে প্রিয় কিছু হারানোর হাহাকার জাগিয়ে ফিরছেন কোনো এক সুরসম্রাট। লখনৌর সেই মজলিস সুর সম্রাটের জন্য অচেনা নয়। প্রতিপক্ষের জন্য ক’দিন আগেও তিনি নায়কই ছিলেন।

ক’দিন আগেও এই সুর, এই ঝংকার সবই ছিল তাঁদের বড় আপন। সময় বদলায়! মাহফিল ছেড়ে যেতে যেতে শিরোস্ত্রাণে তাক করলেন নিজের অস্ত্রখানা। সেখানে বড় করে লেখা ‘নাম্বার ওয়ান’ – একটু নিচেই একটা নাম, রাহুল, কেএল রাহুল।

লোকেশ রাহুল যখন ব্যাট হাতে নামলেন, তখন গোটা স্টেডিয়ামের চোখ যেন স্থির হয়ে গেল তাঁর উপর। করুণ নায়ার আউট হয়ে ফিরছেন, আর রাহুল আসছেন। না, এ শুধু একজন ব্যাটারের নামা নয়, এ যেন কোনও কাব্যিক প্রতিশোধের সূচনা। আজকে কেউ একজন জবাব দিতে এসেছেন, নি:শব্দে, সুরে ডুবিয়ে, ধ্বংসাত্মকভাবে। চোখেমুখে আগুন, পায়ের মাপ জোক নিখুঁত, প্রতিটি রানের মাঝে যেন জমে আছে পুরনো ক্ষত। তিনি জানেন, আজকে রানই হবে তাঁর জবাব।

সেই জবাব এল কী অনবদ্য ভাবে! সোজা ব্যাটে তোলা ছক্কা যখন সাইটস্ক্রিনে গিয়ে আছড়ে পড়ল, তখন গোয়েনকার মুখে এক মুহূর্তের বিস্ময়। তাঁর চোখ বলছিল, শটের তারিফ করছেন তিনি, কিন্তু রাহুলের চোখে ছিল অন্য কথা — ‘এটা তোমার জন্য।’ খেলছিলেন, কিন্তু যেন এক একটা বল বাউন্ডারি পেরোলেই একটা করে অপমান মুছে যাচ্ছিল তাঁর বুক থেকে।

৫৭ রানের অপরাজিত ইনিংস। একটা ভুলও নেই, একটা সুযোগও দেননি। বাউন্ডারি, ছক্কা — সবকিছুর মাঝে ছিল একটা কথা: ‘আমি ফিরেছি, কিন্তু তোমার জন্য না। ‍তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর!’

ম্যাচ শেষে যখন খেলোয়াড়রা একে একে হাত মেলাচ্ছেন, তখন এল সেই মুহূর্ত। লখনৌ কর্ণধার সঞ্জীব গোয়েঙ্কা এলেন সামনে। রাহুলও নিয়ম মেনেই হাত মেলালেন। শুধুই একটা ফরমালিটি। হাসি নেই, কথা নেই। গোয়েঙ্কা কিছু বলার চেষ্টা করলেন, কিন্তু রাহুল ততক্ষণে ঘুরে গেছেন, এগিয়ে যাচ্ছেন সামনে, পরের জনের দিকে।

দৃশ্যটা যেন থেমে ছিল কয়েক সেকেন্ডের জন্য। গোয়েঙ্কা বলেছিলেন, ‘আমি এমন ক্রিকেটার চাই, যারা দলের জন্য খেলে, নিজের জন্য নয়।’ দিল্লী ক্যাপিটালসের বিপক্ষে ম্যাচে সেই কথাটাই যেন বুমেরাং হয়ে ফিরে এল তাঁর দিকে। রাহুল দলের জন্য খেলেন, দলকে জেতানোর জন্য খেলেন। চ্যাম্পিয়নস ট্রফি থেকে আইপিএল, দলের প্রয়োজন ব্যক্তিগত প্রয়োজনকে ছাপিয়ে থাকে।

রাহুল ব্যাট হাতে মাঠে নামেনি, নেমেছিল এক জমে থাকা অভিমানের প্রতিচ্ছবি। শূন্যে ভেসে যাওয়া ছক্কাগুলোর শব্দ যেন বলে যাচ্ছিল, ‘তোমরা আমাকে বোঝোনি, তাই আমি নিজের কথা ব্যাট দিয়েই বলে যাই।’

জবাবটা কি শুধু এক জন মালিকের জন্য? এই জবাব তাঁদের জন্য, যারা ভুলে যান, ক্রিকেটাররাও মানুষ। তাঁদেরও ব্যথা হয়। অপমানে হেঁটে আসা রাতে তাঁরাও নীরবে বলে যান, ‘আমারও একটা গল্প আছে।’ লোকেশ রাহুল এই রাতে খেলতে নামেননি। নেমেছিলেন যেন কোনও এক নিরব বিপ্লব হয়ে। প্রতিটি শটে বাজছিল, ‘তোমরা বোঝোনি।’ প্রতিটি ছক্কা যেন ছুঁয়ে যাচ্ছিল লখনৌর হৃদয়ের গোপন ক্ষত। মঞ্চে দাঁড়িয়ে, এক সুরসম্রাট বলে যাচ্ছিলেন, ‘আমি আছি, থাকব!’

Share via
Copy link