মাতারার ঝড় যেন আজ এক শান্ত নদী

আজ আর তিনি মাঠে ঝড় তুলেন না, এখন তিনি শান্ত চিত্তে পরিকল্পনা সাজান ডাগ আউটে বসে। তবে, আজও তাঁকে দেখলেই প্রতিপক্ষের ভয় কাঁপে। কারণ, সবাই জানে অসম্ভবকে সম্ভব করাই সনাথ জয়াসুরিয়ার কাজ।

গা গরমের অনুশীলন চলছে। আকাশে রোদ আর মেঘের খেলা। গল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়ামের পাশেই সেন্টার উইকেটে ফুটবল খেলছে শ্রীলঙ্কা দল। একটু পাশেই পানির ঝুড়ির ওপর বসে আছেন তিনি। ফোন হাতে নিয়ে মনোযোগ দিয়ে কি যেন দেখছেন, আর কি যেন ভাবছেন।

একটু পর উঠে দাঁড়ালেন। হেঁটে এগিয়ে আসলেন গলের নেট গ্রাউন্ডের দিকে। এক মাঠকর্মীর সাথে কি যেন কথা বললেন। সিংহলিজ ভাষায় আলাপচারিতা হল। তাই শুনে বোঝার উপায় নেই, মাতারা হারিকেন আসলে কি আলাপ করলেন।

মাতারা হারিকেন – নব্বই দশকের তামাম বোলারদের রাতের ঘুম হারাম করার জন্য তো এই একটা নামই যথেষ্ট। উদ্বোধনী ব্যাটিংয়ের সংজ্ঞাই পাল্টে দিয়েছিলেন এই হারিকেন, কাগজে কলমে নাম যার সনাথ জয়াসুরিয়া। দ্য মাস্টার ব্লাস্টার, ওপেনিং ঝড়ের শেষ কথা, আধুনিক ওয়ানডে ক্রিকেটের যে কোনো সেরা একাদশ বানাতে গেলে যার নামটা আসবে বারবার।

সনাথ জয়াসুরিয়া বলতেই চোখে ভেসে ওঠে কামারের হুঙ্কারে গড়া দুটো হাত, পয়েন্ট আর কভারের ফাঁক গলে বুলেট গতিতে বেরিয়ে যাওয়া ড্রাইভ, আর লেগ সাইড পেরিয়ে গ্যালারিতে হারিয়ে যাওয়া বল। অথচ, কল্পনা করাই কঠিন—ক্যারিয়ারের প্রথম পাঁচটা বছর তিনি ছিলেন মূলত একজন বোলার, যার ব্যাটিংটা শুধু বোনাস হিসেবে ধরা হতো।

সেটা বদলে গেল হঠাৎ করেই। ১৯৯৩-র হিরো কাপ, ওপেন করতে পাঠানো হলো তাকে। পরের বছর ঘরের মাঠে পাকিস্তানের বিপক্ষে সিরিজে ঠিক করেই ফেললেন—এটাই আমার জায়গা। এরপর ১৯৯৬ বিশ্বকাপে তাঁর আগুনে ব্যাটিং ভারতকে দিল্লীতে পুড়িয়ে ছারখার করে, ইংল্যান্ডকে শেষ আটে টেনেই ভাসিয়ে দিল।

বিশ্বকাপের পথটা চওড়া করে দিয়েছিলেন সনাথ — চোখ ধাঁধানো শটে, মগজের কৌশলে। সেই যে শুরু, এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। টেস্টেও করতেন এমন গতিতে রান তুলতেন যেটা আজও অনেক ব্যাটারের জন্য স্বপ্ন।

হ্যান্ড-আই কম্বিনেশনে গড়া অসামান্য এক ক্রিকেটার ছিলেন জয়াসুরিয়া। ঝলসে উঠতেন তখনই, ঠিক যখন অনেকে ভাবত সব শেষ হয়ে গেছে। ক্রিকেটটা তাঁর একার খেলার মাঠ ছিল, আর বাকিরা সেখানে দর্শক মাত্র।

বল হাতেও থেমে থাকেননি। বাঁহাতি স্পিনে ৪৪০ আন্তর্জাতিক উইকেটই তার প্রমাণ। জয়াসুরিয়া — একইসঙ্গে বিস্ফোরক, কৌশলী আর কাব্যিক; তিনি একজন ধ্বংসের শিল্পী।

সেই সনাথ জয়াসুরিয়া এখন শ্রীলঙ্কা দলের কোচ। ব্যর্থতা কাটিয়ে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেট যে আবার জেগে উঠেছে তাঁর রূপকার সনাথ জয়াসুরিয়া। এই নতুন ভূমিকায় এখন তিনি শান্ত, অবিচল। ঝড় শেষে যেমন সমুদ্র শান্ত হয়ে যায়, গলের বুকে তেমনই শান্ত এখন সনাথ জয়াসুরিয়া।

আজ আর তিনি মাঠে ঝড় তুলেন না, এখন তিনি শান্ত চিত্তে পরিকল্পনা সাজান ডাগ আউটে বসে। তবে, আজও তাঁকে দেখলেই প্রতিপক্ষের ভয় কাঁপে। কারণ, সবাই জানে অসম্ভবকে সম্ভব করাই সনাথ জয়াসুরিয়ার কাজ। অজেয়কে জয় করার জন্যই মাতারা হারিকেনে এত জয়জয়কার।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link