‘অ্যাটাক জেতায় ম্যাচ আর ডিফেন্স জেতায় ট্রফি’ ম্যাচের আগে আগে সম্ভবত কথাটা ভুলে গিয়েছিলেন পেপ গার্দিওলা। কিন্তু থমাস টুখেল ভুলেননি। চেলসির ১-০ গোলের জয় যেন স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের কথার প্রমাণ দিলো আরেকবার!
ইউরোপটা যে ইংরেজদের হতে চলেছে আরেকবার, সে নিয়ে বিন্দুমাত্র প্রশ্ন ছিল না। পোর্তোর দ্রাগাও স্টেডিয়ামে ‘অল ইংলিশ ফাইনাল’ ছিল দুই কোচের জন্যই প্রমাণের মঞ্চ। একদিকে পেপ গার্দিওলার বার্সা বাবলের বাইরে ইউরোপে নিজেকে প্রমাণ করার, অন্যদিকে থমাস টুখেলের জন্য নিজের আগের দলকে দেখিয়ে দেওয়ার।
মৌসুমের মাঝপথে বরখাস্ত হয়ে চাকরি পেয়েছেন ভঙ্গুর চেলসির। অন্যদিকে মৌসুমের পর মৌসুম ধরে সিটিকে তৈরিই করে যাচ্ছেন পেপ গার্দিওলা। শেষে দিয়ে ভঙ্গুর তরীতে জোড়াতালি দিয়েই ইউরোপকে নীল রংয়ে রাঙিয়েছেন থমাস টুখেল ও তার চেলসি বাহিনী।
ম্যাচ শুরুর আগেই সমর্থকেরা আন্দাজ করতে পেরেছিল, গার্দিওলার ইউরোপভীতি আবার জেগে উঠেছে। সিটির সামনে সুযোগ ছিল ধারা পাল্টানোর। এই শতাব্দীতে মোট সাতবার নতুন কোনো দল চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনাল খেলেছে, তারাই হেরেছে। কেউ যদি পারেন, সেটা গার্দিওলাও পারবেন। সকলে ভেবেছিলেন সেটাই।
কিন্তু, গার্দিওলা গতকাল মাঠে নেমেছিলেন ঢাল ছাড়াই তরোয়াল নিয়ে। লক্ষ্যটা খুবই সাধারণ, আক্রমণাত্বক মনোভাব। এই মৌসুমে খেলা ৬০ ম্যাচের মধ্যে ৫৯ ম্যাচেই তার শুরু একাদশের মুখ ছিল ফার্নান্দিনহো অথবা রদ্রির একজন। অথচ ফাইনালটা তিনি শুরু করলেন তাদের কাউকে ছাড়াই। ১০ বছর পর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল খেলতে নামা পেপ গার্দিওলাকে বিশ্ব দেখল কোন ডিফেন্সিভ মিড ছাড়াই মাঠে নামতে।
সে জায়গায় থমাস টুখেল হেঁটেছেন নিজের চিরচারিত পথেই। নতুন কিছু নয়, বরং যে পথে হেঁটে ফলাফল এসেছে, ঠিক সে পথেই হেঁটেছেন তিনি। চেলসির ভরসার পাত্র এন’গলো কান্তে আর জর্জিনহোতে ভরসা রেখেছেন তিনি। চিরচারিত আক্রমণে ৩-৪-২-১ আর ডিফেন্সে ৫-৩-২ ছকে। নতুন কিছু মাথাতেই আনেননি টুখেল। মেসন মাউন্টকে করেছেন ডিফেন্স আর অ্যাটাকের সমন্বয় হিসেবে। আর সামনে তো ফিনিশার আছেনই।
সারাক্ষণ ট্যাক্টিস আর খেলোয়াড় নিয়ে এক্সপেরিমেন্ট করা গার্দিওলা ফাইনালটাও ছাড়লেন না। নিজের গোয়ার্তুমি কিংবা ট্যাক্টিক্যাল জিনিয়াস প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যেন। নইলে এই সময়ে ফাইনালে কেউ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার ছাড়া খেলে? বরং নামিয়েছেন স্টার্লিং ও মাহরেজকে।
অথচ, ফাইনালের আগ পর্যন্ত স্টার্লিংয়ের উপর ভরসাই করেননি গার্দিওলা। গার্দিওলা সম্ভবত টুখেলের বিপক্ষে শেষ দুই হারকে বেশ বাজেভাবেই নিয়েছিলেন। টুখেলের ট্যাক্টিসের সামনে কোনো কাজেই আসেনি তার ডিফেন্সিভ মিড। সে কারণেই হয়তো কোন ডিফেন্সিভ মিড ছাড়াই মাঠে নেমেছিলেন গার্দিওলা।
কিন্তু তাতে লাভের লাভ হয়নি কিছুই। বরং ম্যাচের শুরুতেই মিডফিল্ড ব্যাটেলে চেলসির কাছে পিছিয়ে পড়েছে সিটি। বল পজেশন রাখছিলেন ঠিকই, কিন্তু মাঝমাঠ আর নিজের কন্ট্রোলে আনতে পারছিলেন না। হাই লাইন ডিফেন্সে খেলা সিটি ধরতেই পারেনি চেলসির খেলা।
ফলে মেসন মাউন্ট যখন নিজেদের লাইন থেকে বিশাল লং বল বাড়ালেন তাকে ধরতেই পারেননি সিটির ডিফেন্ডাররা। ম্যাচে বলার মতন অসাধারণ একটা সুযোগ পেয়েই কাজের কাজ করে নিয়েছে চেলসি। কাই হাভার্টজ নিজের ক্যারিয়ারের প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ গোল করে রাখলেন স্মরণীয়। ৪২ মিনিটে এডারসনকে কাটিয়ে জালে পৌঁছে দিয়েই মেতে উঠেছেন আনন্দে। আর সেই গোলটাই হয়ে রয়েছে চেলসির ইউরোপ জয়ের আখ্যান।
ম্যাচে যে দুই দলের জন্য ধাক্কা আসেনি, তা কিন্তু নয়। ৩৯ মিনিটে ডিফেন্সের নেতা থিয়াগো সিলভাকে হারিয়ে ফেলেছিল চেলসি। কিন্তু ক্রিশ্চেনসেন তার অভাবটা বুঝতেই দেননি বাকি ম্যাচে। অধিনায়ক সিজার আজপিলিকুয়েতাও সিলভার চলে যাওয়ার পর হয়ে উঠেছেন ভোকাল। পুরো ডিফেন্স একাই নেতৃত্ব দিয়ে গিয়েছেন তিনি। সভাই যখন ভাবছিল সিলভাকে হারিয়ে বড় ধাক্কা খেল চেলসি, তখনই গোল করে জানান দিয়ে দিয়েছেন হাভার্টজ।
ধাক্কা খেয়েছে সিটিও। ম্যাচের ৫৬ ইনিটে এসে হারিয়ে নিজেদের প্লে মেকার ডি ব্রুইনাকে। তাকে সরিয়ে নিয়ে নামিয়েছেন গাব্রিয়েল হেসুসকে। নামিয়েছেন ফার্নান্দিনহোকে। এমনকি শেষদিকে নিজেদের লিজেন্ড আগুয়েরোকেও নামিয়েছেন শেষ চেষ্টা হিসেবে।
কোনোটাই কাজে দেয়নি গার্দিওলার দলের জন্য। গোল হজম করার পরই যেন নিজেদের হারিয়ে ফেলেছিল সিটি। একজন লিডারের অভা ছিল স্পষ্ট। শেষদিকে আগুয়েরো চেষ্টা করলেও রূপকথা লেখা হয়নি।
ইউরোপের আকাশ আকাশী-সাদা করতে পারেনি গার্দিওলা বাহিনী, বরং টুখেল জিতে নিয়েছেন তার প্রথম চ্যাম্পিয়নস লিগ! গত এক বছরের ব্যর্থতা অপমানের শোধ নিয়েছেন চ্যাম্পিয়নস লিগ ট্রফিতে চুমু খেয়েই। সেই সাথে ৯ বছর পর চেলসিকে ইউরোপ সেরা করে।