দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের ফুটবল নানা হতাশার মধ্যদিয়ে যাচ্ছে। সেরা দুটি সাফল্য বলতে গেলে ১৯৯৯ সালের সাফ গেমসে স্বর্ণ জয় আর ২০০৩ সালে সাফ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন। সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সাথে ভারতের ম্যাচের একটা সাদৃশ্য রয়েছে। প্রিয় আর চিরশত্রু দেশটির বিপক্ষে যে সর্বশেষ জয়টি এসেছিল ১৮ বছর আগে। সেই আসরের সেমিফাইনালে রোকনুজ্জামান কাঞ্চন আর মতিউর মুন্নার গোলে ২-১ ব্যবধানে জিতেছিল স্বাগতিকরা।
এরপর থেকে ভারত বধের স্বপ্ন দেখা হলেও সেটি পূরণ হচ্ছেনা। দেড় যুগের এই সময়ে মাত্র তিনটা ম্যাচ ড্র করতে পেরেছে বাংলাদেশ। তারও চারবছর আগে ১৯৯৯ সালে নেপালে সাফ গেমস ফুটবলের ফাইনালে আলফাজ আহমেদের একমাত্র গোলে জয় দিয়ে প্রথম শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। দুটি আসরের সাফল্যের পেছনে কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল ষ্ট্রাইকারদের। কিন্তু এখন আর স্ট্রাইকারদের পা থেকে প্রত্যাশিত গোল আসছেনা। অবধারিত সুযোগগুলো মিস করার কারণেই জয় পাওয়ার সম্ভাবনায় থাকা ম্যাচগুলো যেমন ড্র করছে বাংলাদেশ, আবার পয়েন্ট পাওয়ার সম্ভাবনায় থাকা ড্র ম্যাচগুলো হারতে হচ্ছে।
বিশ্বকাপ ও এশিয়ান কাপ বাছাইপর্বের খেলায় আফগানিস্তানের বিপক্ষে ড্র’য়ের মূল কৃতিত্ব কিন্তু একজন ষ্ট্রাইকারের নয়, ডিফেন্ডারের। তপু বর্মনের মহামূল্যবান গোলটির কারণেই এখন পর্যন্ত ফুটবলের জাতীয় দল নিয়ে আলোচনাটা অব্যহত রয়েছে। হারলে কোচ থেকে শুরু করে খেলোয়াড়দের মন্ডুপাত করা শুরু হয়ে যেত। তবে আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচে যেভাবে দ্বিতীয়ার্ধে বাংলাদেশ খেলেছে তাতে করে জয় না পাওয়াটাই বরং হতাশার।
মোহাম্মদ আবদুল্লাহ যে গোল মিস করেছেন সেটি অন্য যে কোন দেশের ষ্ট্রাইকাররা গোলে পরিণত করতে পারতেন। মূল পার্থক্যটা আসলে তৈরি হয়ে যাচ্ছে এখানেই। ফুটবলপ্রেমীদের মুখের কাছে কান পাতলেই শোনা যাবে, দেশের ফুটবলে মানসম্পন্ন আর দক্ষ গোল স্কোরের অভাবের কথা। একজন ভালো ষ্ট্রাইকার দলের জন্য কতটা প্রয়োজন সেটি বছরের পর বছর ধরে টেরে পেয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। বিদেশের মাটিতে জয়ের দেখা পাওয়ার পর দেশে ফিরে একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে ড্র মেনে নিতে হয়।
কিছুটা পিছিয়ে গেলে পরিসংখ্যান ঘেটে দেখতে বোঝা যাবে। ১৯৮৫ সালে বিশ্বকাপ বাছাইপর্বে খেলা শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ৫৬টি ম্যাচে গোল সংখ্যা মাত্র ৩৭ টি। যার মধ্যে আবার একটি ছিল আত্বঘাতি। যে গোলগুলো করেছেন ২৪ জন খেলোয়াড়। যার মধ্যে আবার ২২/২৩ টির বেশি গোল করতে পারেনি ষ্ট্রাইকাররা। বাকিগুলো তপু বর্মনের মতো ডিফেন্ডাররা মাঝে মধ্যেই ত্রাতার ভুমিকায় অবতীর্ণ হন। তপুর পাশাপাশি কায়সার হামিদ, জুয়েল রানা আর মোহাম্মদ সুজনরাও পেয়েছেন গোলের দেখা।
এবারের বাছাইপর্বে খেলার আগের ভিতটা তৈরি হয়েছিল লাওসের বিপক্ষে ম্যাচে। প্রাক বাছাইয়ের সেই ম্যাচটি মাঠে নামার আগে বাংলাদেশ দলের অ্যাওয়ে ম্যাচে গোল হজম না করার লক্ষ্য ছিল। বাচাঁ-মরার সেই ম্যাচে রবিউল হাসানের একমাত্র গোলে ১-০ ব্যবধানে জয় পায় বাংলাদেশ। ১০ নাম্বার জার্সিধারী সেই খেলোয়াড়টি দেশের ফুটবলের গোল্ডেন বয় হিসেবে পরিচিত পেয়ে গিয়েছিলেন।
পরে দেশের মাটিতে ফিরতি ম্যাচটি গোলশুন্য ড্র করে বাছাইয়ের মূলপর্বে জায়গা করে নেয় জেমি ডে’র শীষ্যরা। রবিউল ২০১৯ সালে কম্বোডিয়ার নমপেনে স্বাগতিক দলের বিপক্ষেও গোল করেন রবিউল। বিদেশের মাটিতে টানা দুটি ম্যাচে বদলি হিসেবে নেমে গোল করার রেকর্ড কোন বাংলাদেশির সাম্প্রতিক সময়ে নেই। সেই বরিউল এখন হাহাকারের আরেক নাম। জাতীয় দলের অপরিহার্য সদস্য হয়ে এখন তিনি অনেকটাই ’নিখোজ’ অবস্থায় রয়েছেন।
অথচ লাল সবুজ জার্সি গায়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দেখিয়ে অপরিহার্য সদস্য হলেও এখন বয়স ২১ হওয়ার আগেই হারিয়ে যাওয়াদের তালিকায় নাম উঠেছে তার। অথচ ২০১৮ সালে আরামবাগ ক্রীড়া সংঘের হয়ে স্বাধীনতা কাপ জয়ে রেখেছেন দারুণ ভুমিকা। পরের বছরই দলের অধিনায়কত্বের আম্যব্যান্ড উঠার পর ২০১৮-১৯ মৌসুমের প্রিমিয়ার লিগ ফুটবলে জেতেন সেরা উদীয়মান খেলোয়াড়ের পুরস্কার।
তারপরের ঘটনা তো সবারই জানা। দেশের ফুটবলে কাড়ি কাড়ি টাকা নিয়ে আবির্ভুত হওয়া বসুন্ধরা কিংস তাকে দলে ভেড়াতে আটঘাট বেধে মাঠে নামে। কোচ অস্কার ব্রুজোন যে কোন মূল্যে তাকে দলে পেতে চেয়েছিলেন। অনেকটা অবিশ্বাস্য মূল্যে পরের মৌসুমে নতুন এই দলের জার্সি গায়েচাপান রবিউল। পতনের শুরুটা হয় সেখান থেকেই। এরপর তো নিজের নামের ভারেই ন্যুয়ে পড়েছেন। এটি বাংলাদেশের জন্য প্রতীকি ছবি হতে পারে।
বিদেশিদের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে যে ক্ষতিটা হচ্ছে সেটি দেশের ফুটবলের। দেখা যাচ্ছে জাতীয় দলের একাদশের খেলোয়াড়কে ক্লাব ফুটবলের রিজার্ভ বেঞ্চে বসে থাকতে হয়েছে। কাতারের আগে নেপালে সর্বশেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট খেলে বাংলাদেশ। গ্রুপপর্বের দুটি ম্যাচে নিজেরা কোন গোল না করেই ফাইনালে পৌছে যায় লাল সবুজ প্রতিনিধিরা। নেপালের বিপক্ষে শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচে টুর্নামেন্টের একমাত্র গোলটি করেন মাহবুবুর রহমান সুফিল। কিরগিজস্তান অনুর্ধ্ব-২৩ দলের বিপক্ষেও বাংলাদেশের জাতীয় দলের কোন ষ্ট্রাইকার গোলের খাতা খুলতে পারেননি। তিন ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের গোল সংখ্যা ছিল একটি!
এভাবেই দেশের ফুটবল এগিয়ে যাচ্ছে। স্ট্রাইকারদের বেড় ওঠা আর হারিয়ে যাওয়ার গল্পটাও এমনভাবে রচিত হচ্ছে। বছরের পর বছর চেষ্টা করেও নির্ভরযোগ্য স্ট্রাইকার তৈরি করতে পারছেনা বাংলাদেশ। সে কারণে ক্লাব দলের ফরোয়ার্ড পজিশনগুলো প্রতিনিয়ত হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেশীয় খেলোয়াড়দের। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) পক্ষ থেকে কয়েক বছর আগে ‘স্ট্রাইকার হান্ট’ নামে একটা কার্যক্রম হাতে নেওয়া হলেও সুফল পাওয়া যায়নি। বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াসলি ভাববার সময় এসেছে এখন।