দ্য আর্মলেস ওয়ারিওর

ক্রিকেট শুধু ভদ্রলোকের খেলা নয়, ক্রিকেট সবার খেলা। শারীরিক সীমাবদ্ধতা তাঁকে থামিয়ে দিতে পারেনি—বরং তিনি বিশ্বকে শিখিয়েছেন, মানুষের মন যদি অটুট থাকে, তবে শরীরের কোনো অভাবই তার স্বপ্নের পথে বাঁধা হতে পারে না।

৭৯ হাজার ফলোয়ারের ছোট্ট একটা ফেসবুক পেজ। একজন ক্রিকেটারের। প্রোফাইলে শচীন টেন্ডুলকারের সাথে একটা ছবি, বায়োগ্রাফিতে লেখা – দ্য আর্মলেস ক্রিকেটার। ভদ্রলোকের নাম আমির হুসেইন লোনি, ভারতের জম্মু ও কাশ্মীরের ক্রিকেটার। হ্যাঁ, সত্যিই হাত নেই তাঁর। অথচ, তিনি পুরোদস্তর বোলার।

হাত নেই, কিন্তু ক্রিকেট খেলতে তাঁর শারীরিক এই অক্ষমতা কোনো বাঁধা হয়নি। পা দিয়ে স্পিন করেন, ব্যাটিং করেন দলের প্রয়োজনে। ফিল্ডিংয়ে দারুণ। তিনি সত্যিকারের একজন যোদ্ধা, ক্রিকেট খেলাটা তাঁর জন্য যুদ্ধের চেয়ে কম নয়। সম্প্রতি শ্রীলঙ্কায় একটা টুর্নামেন্ট খেলতে গিয়ে ভারতের প্যারা ক্রিকেট দলের হয়ে তিনি আলোচিত হয়েছেন।

মাত্র আট বছর বয়সে, ১৯৯৭ সালে আমির হারিয়েছিলেন তাঁর দুই হাত। পরিবারের সবার সাথে ঘটে যাওয়া সেই দুর্ঘটনায় এক মুহূর্তে বদলে দিয়েছিল একটি শিশুর জীবন। সাধারণত এমন ক্ষত মানুষের স্বাভাবিক জীবন থামিয়ে দেয়। কিন্তু আমিরের জীবন যেন উল্টো পথে বয়ে চলা নদী—যেখানে সকল বাঁধাই শক্তি হয়ে ফিরে এসেছে।

হাত নেই, তাই কি ক্রিকেট থেমে যাবে? অন্যরা যেটাকে অসম্ভব ভাবত, আমির লোনি সেটাকেই নিজের আলাদা পরিচয় বানিয়ে ফেললেন। তিনি ব্যাট ধরলেন হাতে নয়, গলায়—চিবুক আর ঘাড়ের মাঝখানে চেপে ধরে খেলতে শুরু করলেন। বোলিংয়ে হাতের অভাব পুষিয়ে নিলেন পায়ের নিখুঁত নিয়ন্ত্রণে। ধীরে ধীরে আশপাশের মানুষের বিস্ময় বদলে গেল শ্রদ্ধায়। মাঠে নামলেই ভিড় জমে যেত শুধু তাঁর অদ্ভুত, তবু অবিশ্বাস্য প্রতিভা দেখার জন্য।

২০১৩ সালে দিল্লঅতে কেরালা দলের বিপক্ষে ম্যাচ যেন তাঁর জীবনের নতুন মোড়। খবরের কাগজ, টিভি—সবাই লিখল সেই ছেলেটির কথা, যে হাত হারিয়েও ক্রিকেটকে হার মানতে দেয়নি। ব্যাটিংয়ের সময় গলা দিয়ে ব্যাট চেপে ধরে যে শট খেলতেন, তাঁর সেই খেলার ধরণ দেখে অভিজ্ঞ ক্রিকেটাররাও বিস্মিত। খোদ শচীন টেন্ডুলকার এসে পিঠ চাপড়ে দেন। আর তাঁর লেগ-বোলিং—মনে হতো যেন পায়ের গতি, ভারসাম্য আর সাহস মিলে তৈরি এক নতুন ধরনের শিল্প।

আমির শুধু ক্রিকেট খেলেননি—প্রমাণ করেছেন, প্রতিভা কখনও শরীরের ওপর নির্ভর করে না; নির্ভর করে ইচ্ছাশক্তি আর অসম্ভবকে সম্ভব বানানোর জেদে। ক্রিকেট শুধু ভদ্রলোকের খেলা নয়, ক্রিকেট সবার খেলা। শারীরিক সীমাবদ্ধতা তাঁকে থামিয়ে দিতে পারেনি—বরং তিনি বিশ্বকে শিখিয়েছেন, মানুষের মন যদি অটুট থাকে, তবে শরীরের কোনো অভাবই তার স্বপ্নের পথে বাঁধা হতে পারে না।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link