একদিন খেলার ফাঁকে হঠাৎ মোবাইল বেজে উঠল। জ্লাতান ইব্রাহিমোভিচ মাঠ থেকে বেরিয়ে গেলেন, দশ মিনিট ধরে ফোনে গল্প করলেন, তারপর আবার যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে মাঠে ফিরে এলেন। সেই দিন নাকি ফুটবলে জন্ম নিল হাফটাইম—এমন গল্প ছড়িয়ে পড়ে মানুষের মুখে মুখে।
প্যারিসে নামতেই সাংবাদিকেরা ভিড় করে প্রশ্ন করল, ‘আপনি এখানে কেন, স্যার?’ জ্লাতান ঠাণ্ডা গলায় জবাব দিলেন, ‘মোনালিসা ছাড়া প্যারিসের মানুষের দেখার মতো কিছু ছিল না এতকাল, তাই আমি এলাম।’ হ্যাঁ, এটাই জ্লাতান, তিনি জানতেন তিনি আলাদা।
ঘটনাগুলো বানানো—সেটা সত্য। কিন্তু যে চরিত্রকে কেন্দ্র করেই গল্পগুলি ঘুরে বেড়ায়, তিনি মোটেও কাল্পনিক নন। সুইডেনের ম্যালমো শহরে ছেলেটা স্কুলে যেত শুধুই ফ্রি লাঞ্চ খাওয়ার জন্য। একটু বড় হয়েই রাতের অন্ধকারে বাইক চুরি, লকার ভেঙে টাকা নিয়ে পালানো, পকেট মেরে লম্বা চুলটা উড়িয়ে বস্তির অলিতে গলিতে হারিয়ে যাওয়া—এই ছিল তাঁর জীবন।

মা-বাবা ছিলেন আশ্রয়ের চেয়ে বেশি অনুপস্থিত অভিভাবক। বসনিয়া, সার্বিয়া আর তুর্কি শরণার্থীদের গাদাগাদি ঘরবাড়ি ঘেরা স্যাঁতসেঁতে গলিতে রাতভর চলত স্ট্রিট ফুটবল। টাকা রেখে গোল করায় দুরন্ত সুনাম ছিল তার; বস্তির খ্যাপ মারা খেলোয়াড়দের নয়নের মণি জ্লাতান।
নিজের আত্মজীবনীতে জ্লাতান লিখেছেন তাঁর নায়কের কথা—মোহাম্মদ আলী। অন্ধকারে ডুবে থাকা শৈশবের মাঝেও ফুটবলের মতো আলোটা আঁকড়ে ধরে থাকতেন তিনি, আর আলী ছিল তাঁর বাঁচার শক্তি। হয়তো ভেবেছিলেন, যেভাবে আলী বিশ্বের সামনে দাঁড়িয়ে ন্যায়ের ঘুষি ছুড়েছিলেন, তিনিও একদিন অন্ধকারের পক্ষে থেকে সভ্যতার দিকে একটা পাঞ্চ ছুড়ে দেবেন। ঘোষণা করবেন, তিনিই সভ্যতা, বাকি সব মিথ্যা।
মদ্যপ বাবা, উদাসীন মা, দারিদ্র্য আর আন্ডারওয়ার্ল্ডের মোচড়ানো বাস্তবতার ভেতর নিজের চুল শক্ত করে বাঁধা এক জ্লাতান প্রতিদিন নতুন করে জন্ম নিতেন শুধু বাঁচার জন্য। রোনালদো-মেসির আলোয় ভরা যুগে তারা আসে ধূমকেতুর মতো—হঠাৎ, দীপ্ত, উগ্র, আর নিজের আলোয় অনন্য।

২০১২ সালে পিএসজিতে যোগ দিয়ে অকপটে বলেছিলেন, ‘লিগ ওয়ান সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না, কিন্তু তারা জানে আমি কে।’ প্যারিসে বাড়ি খুঁজে পাওয়া কঠিন হচ্ছিল, কিন্তু জ্লাতান ছিলেন নিশ্চিন্ত — ‘অ্যাপার্টমেন্ট না পেলে সমস্যা নেই, একটা হোটেল কিনে নেব।’
২০১৩ সালে পর্তুগালের সঙ্গে বিশ্বকাপ প্লে-অফের আগে সাংবাদিক জানতেই চাইলেন ফল কী হবে। জ্লাতান বললেন, ‘শুধু ঈশ্বর জানেন।’ সাংবাদিকের পাল্টা প্রশ্ন, ‘তাকে তো আর জিজ্ঞেস করা যাবে না।’ জ্লাতান হেসে হাসলেন — ‘আপনি এখন তাঁর সাথেই কথা বলছেন।’ হ্যাঁ, ম্যাচটা হেরেছিলেন। তিনি ঐশ্বরিক ছিলেন, দলটা কেবল তাঁর সাথে তাল মেলাতে পারেনি।
মদ্যপ বাবা, উদাসীন মা, দারিদ্র্য আর আন্ডারওয়ার্ল্ডের আঁধার পেরিয়ে চুল পেছনে টেনে বাঁধা একদল জ্লাতান জন্ম নেয় নতুন লড়াইয়ের জন্য। রোনালদো-মেসির আলোয় ভরা চাকচিক্যের দুনিয়ায় তারা আসে ধূমকেতুর মতো—হাজারও দহনে পুড়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে হয়ে ওঠেন অদম্য।

তিনি হয়তো উল্কার মতোই মিলিয়ে যান মাঝে মাঝে, কিন্তু যাওয়ার আগে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে বলে যেতে পারেন, ‘ওরা আমাকে অবসরের কথা বলে; আমি তাদের রাষ্ট্রকেই অবসরে পাঠিয়ে দিই।’ সেই স্পর্ধার নাম জ্লাতান। জ্লাতান যা করতেন, যা বলতেন, বাকিরা তা ভাবার সময়ও পান না।










