সরব-নীরব লুকাকু

গতকাল দিনটা ঠিক ফুটবলের ছিল না। বরং ছিল প্রতিটি ফুটবল খেলোয়াড়, দর্শক, সমর্থকদের জন্য এক মূর্তিমান আতঙ্ক। এরিকসেনের এক ঘটনা থমকে দিয়েছিল পুরো বিশ্ব। এরিকসেনের সুস্থতার খবর পেয়েই মাঠে নেমেছিল বেলজিয়াম আর রাশিয়া। আর রোমেলু লুকাকু নেমেছিলেন নিজের সতীর্থর প্রিয় মুখটা মনে করে। আর সেই সাথে পুরো বেলজিয়ামের দায়িত্ব নিয়ে।

এবারের ইউরোর হট ফেবারিটের তালিকায় উপরের দিকেই নাম আছে বেলজিয়ামের। তারা সেরকম খেলছেও। নিজেদের ইতিহাসের সেরা দল নিয়ে এবার ইউরোতে এসেছে তারা। গত বিশ্বকাপে তারা কাঁটা পড়েছিল সেমিফাইনালে। এবার আর সেখানে কাঁটা পরতে চায় না, তাই প্রস্তুতিটাও অন্যরকম।

সে প্রস্তুতিতে জল ঢেলে দিয়েছে বেরসিক ইনজুরি। দলের অধিনায়ক, সহ-অধিনায়ক দুজনেই চোটে মাঠের বাইরে। হ্যাজার্ড তো পুরো মৌসুমে খেলতেই পারেননি। আর মৌসুমের শেষ ম্যাচে এসে রুডিগারের ট্যাকেলে ইনজুরিতে পরেছেন ডি ব্রুইনা। বলতে গেলে এক কথায় দলের সেরা দুই খেলোয়াড়কে ছাড়াই রাশিয়ার বিপক্ষে নামতে হয়েছিল বেলজিয়ামকে। আর সেই সাথে ম্যাচের লিডারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল ভঙ্গুর লুকাকুকে।

লুকাকু সেই দলকে নিয়েই মাঠে নেমেছিলেন, আর নেমেই মুখোমুখি হয়েছেন বর্ণবাদের। রাশিয়ায় অন্যান্য ইউরোপিয়ান দেশের থেকে বর্ণবাদ একটু বেশিই। সেখানে কোনো কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় খেলতে গেলেই শুনতে হয় দুয়ো।

‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স’ আন্দোলনে সামিল হয়ে যখন বেলজিয়ামের খেলোয়াড়েরা হাঁটু গেড়ে বসেছিলেন, তখন রাশিয়ার খেলোয়াড়েরা ছিলেন ঠায় দাঁড়িয়ে। তাদের মুখের সামনে কৃষ্ণাঙ্গদের হয়ে যেন প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন লুকাকু। আর এরপরেই শুরু হয় তার তাণ্ডব।

প্রথম ২০ মিনিট রাশিয়ার ডিফেন্সকে একাই নাচিয়েছেন রোমেলু লুকাকু। তৈরি করেছেন ৩ গোলের সুযোগ। নিজের বাজে ফার্স্ট টাচের ফলাফলে গোল পাননি তিনি। কিন্তু ১০ মিনিটে বেলজিয়ামের প্রথম আক্রমণটা মিস করেননি। ড্রিস মের্তেন্সের করা ক্রসের জন্য ওঁত পেতে ছিলেন লুকাকু। কিন্তু অফসাইডে। রাশিয়ান ডিফেন্ডার আন্দ্রেই সেমেনভ বল ক্লিয়ার করতে গিয়ে উল্টো সুযোগ করে দেন লুকাকুকে। আর সেখান থেকে গোল করেই এগিয়ে নেন বেলজিয়ামকে।

গোলটা যতটা না সুন্দর ছিল, তার থেকে সুন্দর ছিল তার উদযাপন। দৌড়ে গিয়েছেন ক্যামেরার দিকে। আর চিৎকার করে বলেছেন, ‘ক্রিস, ক্রিস… আমি তোমাকে ভালোবাসি!’ ইন্টারে নিজের ফিরে আসার মৌসুমের পেছনে অনেকটা অবদান ছিল এরিকসেনের।

মৌসুমের প্রথমভাগে লুকাকুর গোলের বল জোগান দিতেন এই এরিকসেনই। একের পর এক ম্যাচ জিতিয়েছেন লুকাকু, আর পেছন থেকে সাহায্য করে দিয়েছেন এরিকসেন। তাই এরিকসেনের বিপদের দিনে তাঁকে ভুলেননি লুকাকু, বরং তাকে মনে করেই শেষ করেছেন গোল।

তাকে নিয়ে কম কথা হয়নি গত কয়েক বছরে। ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডে বিশাল দামে গিয়েও কিছু করতে পারেননি। একপ্রকার অর্ধচন্দ্র দিয়েই তাকে বের করে দেওয়া হয়েছে। গিয়েছেন ইন্টারে। কন্তের দেওয়া সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন লুকাকু।

তার উপরে ভর করে কন্তে ভেঙেছেন জুভেন্টাসের ৯ বছরের ইতালিয়ান শাসন। ইন্টারকে করেছেন সিরি-আ চ্যাম্পিয়ন। সবকিছু নিয়েই ইউরোতে এসেছিলেন লুকাকু। বেলজিয়ামের ভরসা হয়ে। আর প্রথম ম্যাচেই তা প্রমাণ করেছেন।

ম্যাচের শুরুতে যেমন সুযোগ কাজে লাগিয়েছেন, শেষটাও করেছেন সেভাবেই। মুনিয়েরের ডিফেন্সভাঙ্গা পাস নিজের বুদ্ধিমত্তার সাথে প্লেসমেন্ট করে দলকে নিয়ে গিয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। দ্বিতীয় গোলের সাথে সাথে জিতিয়েছেন বেলজিয়ামকে। সেই সাথে মুখে ঝামা ঘষে দিয়েছেন রাশিয়ানদের। সেই সাথে ম্যাচ সেরার পুরস্কার।

‘ব্ল্যাক লাইফ ম্যাটার্স’ দাবিতে বরাবরই সোচ্চার লুকাকু। সে জন্য মাঠের মাঝেই দুয়ো শুনতে হয়েছে দর্শকদের কাছ থেকে। এমনকি রাশিয়ান খেলোয়াড়েরাও সম্মতি জানায়নি তার কিংবা বেলজিয়ামের আন্দোলনের সাথে। আর ম্যাচ শেষে সেটারই যেন একটা জবাব দিয়েছেন লুকাকু। রাশিয়াকে একা হাতে হারিয়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link