ফাইনালের আগেই ফাইনাল। ফুটবলবোদ্ধারা অনেকেই ভবিষ্যৎবাণী করেছেন এ ম্যাচের জয়ী দলই পড়বে এবারের ইউরোর বরমাল্য। একদিকে বিশ্বর্যাংকিংয়ের এক নম্বর দল বেলজিয়াম অন্যদিকে টানা ৩১ ম্যাচ অপরাজিত বদলে যাওয়া ইতালি। সেয়ানে সেয়ানের এই লড়াইয়ে শেষ হাসিটা ইতালিরই, বারেল্লা এবং ইনসিগনের গোলে ম্যাচটি তারা জিতে নিয়েছে ২-১ গোলে।
‘স্ট্রাইকাররা আপনাকে ম্যাচ জেতাবে কিন্তু ডিফেন্ডাররা জেতাবে টুর্নামেন্ট’ স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের এই উক্তি অমর হয়ে আছে বিশ্ব ফুটবলে। গতকাল ইতালির জয়টা পরোক্ষভাবে যেন স্যার অ্যালেক্সের কথাকেই সমর্থন জানালো। রক্ষণাত্নক ফুটবলের দেশ ইতালি ফুটবলকে উপহার দিয়েছে মালদিনি, বারেসি, নেস্তা, ক্যানাভারোদের মতো ডিফেন্ডারদের। তাদের প্রতিনিধি হিসেবেই রয়ে গেছেন কিয়েল্লিনি-বনুচ্চি।
এক দশকের বেশি সময় ধরে জুভেন্টাস এবং ইতালির রক্ষণভাগের দায়িত্বটা সামলে যাচ্ছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। জাতীয় দলে কিয়েলিনির অভিষেক ২০০৪ সালে, তারও বছরপাঁচেক পরে জাতীয় দলে আগমন বনুচ্চির। সেই শুরু, ক্যানাভারোর রেখে যাওয়া বাটনটা যেন ভাগাভাগি করে তুলে নিয়েছেন দুজনে, রক্ষণভাগে দুর্গ গড়ে তুলে ইনসিগনে-ইম্মোবিলেদের আক্রমণে পুরো মনোযোগের লাইসেন্স দেন। এই ইউরোতে কেবলমাত্র এক গোল হজম করেছে ইতালি, সেটাও অস্ট্রিয়ার বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে গিয়ে।
মূল লড়াইটা ছিল ইতালির রক্ষণভাগের সাথে বেলজিয়ামের আক্রমণভাগের। লুকাকু-ডি ব্রুইনার সাথে কিয়েল্লিনি-বনুচ্চির। সেখানে লড়াইয়ে জিতে গেলেন ইতালিয়ান দুই যুগলই। পুরো ম্যাচে লুকাকুকে রেখেছিলেন খোলসবন্দী করে, বারবার সুযোগ পেলেও গোল করতে দেননি ক্লাব ফুটবল ইতালিতে খেলা এই স্ট্রাইকারকে। ডি ব্রুইনা চেষ্টা করেছেন কিন্তু কার্যকর হতে পারেননি এই দুইজনের সামনে।
কিয়েল্লিনি-বনুচ্চি আগে থেকেই প্রচারের আলোয় থাকলেও এই ইউরো দিয়েই নিজের জাত চিনিয়েছেন লিওনার্দো স্পিনাৎজোলা। এএস রোমার হয়ে খেলা এই লেফটব্যাক এই ইউরোতে অসাধারণ ফুটবল খেলছিলেন। আক্রমণে ইনসিগনকে সাহায্য করা কিংবা রক্ষণে নেমে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই সবখানেই সরব উপস্থিতি তার। এমনকি ইতালি এবার ইউরো জিতলে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট যাবে তার কাছেই এমন কথাই ভাসছিল স্টেডিয়ামের আশেপাশে।
৬০ মিনিটের কথাই ধরুন নাহ ডি ব্রুইনার ক্রসে লুকাকু ঠিকভাবে পায়ে না লাগাতে পারলেও ডোনারুম্মা জায়গামতো না থাকায় বল যাচ্ছিল জালেই। কিন্তু সদাপ্রস্তুত স্পিনাৎজোলা, পায়ের উরু দিয়ে ঠেকিয়ে দিলেন নিশ্চিত এক গোল। লুকাকুর পাশাপাশি স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকের তখন মাথায় হাত। কিন্তু অঘটনটা ঘটে যায় ৬৯ মিনিটে, পায়ের পেশি ছিঁড়ে যাওয়ায় এবারের ইউরো তো বটেই, এ বছরের জন্যই ফুটবল থেকে ছিটকে গেছেন এই ফুটবলার।
ডোনারুম্মার কথাও ভুলে গেল চলবে না, মাত্র ১৭ বছর বয়সে জাতীয় দলে অভিষেক হওয়া এই কিপার আন্তর্জাতিক ফুটবলে বছরপাঁচেক কাটিয়ে ফেললেও এখনো এক ম্যাচে একাধিক গোল হজম করেননি। এ ম্যাচেও রাখলেন নিজের ঝলক, ডি ব্রুইনা-ডকু-লুকাকুদের হতাশ করেছেন দারুণ সব সেভ করে।
বেলিজিয়ামের সোনালি প্রজন্মের একসাথে এটাই শেষ টুর্নামেন্ট। টুর্নামেন্টের আগে তাই ডার্কহর্স হিসেবে সবাই বেছে নিয়েছিলেন লাল-কালোদেরই। কিন্তু নিজেদের নামের প্রতি সুবিচার করতে পারলেন না রবার্তো মার্টিনেজের শিষ্যরা। ইনজুরি কাটিয়ে খেলতে নামা ডি ব্রুইনা কিংবা হ্যাজার্ডের বদলি হিসেবে নামা তরুণ জেরেমি ডকু বাদে কেউই নিজের স্বভাবসুলভ খেলা খেলতে পারেননি।
আরো একবার চাপের মুখে ভেঙে পড়লেন রোমেলু লুকাকু। দলের প্রয়োজনের সময়ে রাখতে পারেননি নিজের ছাপ, শিশুসুলভ সব মিস করে আফসোস বাড়িয়েছেন কেবল। কোচ হিসেবে রবার্তো মার্টিনেজের সিদ্ধান্তও প্রশ্নবিদ্ধ, পিছিয়ে থাকা অবস্থায় তিয়েলেমেন্সকে তুলে কারাস্কোকে না নামিয়ে আনফিট নাসের চাঁদলিকে কেন নামালেন তার উত্তর জানেন কেবল তিনিই। ২০১৬ ইউরো কিংবা ২০১৮ বিশ্বকাপের মতো এবারো তাই বেলজিয়ামকে বিদায় নিতে হলো ফাইনালের আগেই।
টুর্নামেন্ট শুরুর আগেই ইতালি কোচ রবার্তো মানচিনি জানিয়েছিলেন তার দল ইউরোতে এসেছে চ্যাম্পিয়ন হতে। ফাইনালের আগে এখন আজ্জুরিদের সামনে কেবল স্প্যানিশ বাঁধা। স্পেনের নতুন টিকি-টাকা নাকি ইতালির কাতেনাচ্চিও কারা থাকবেন ওয়েম্বলির ফাইনালে এখন কেবল সেটা জানার অপেক্ষা। না, বাকিদেরও রাখতে হবে হিসাবের খাতায়।