অলিম্পিকের ইতিহাসে ক্রিকেট! কথাটা শুনে সবারই মনে বেশ খটকা লাগবে। খটকা লাগাটাই স্বাভাবিক। আপনার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে অলিম্পিকেও ক্রিকেট হয়েছিল? উত্তর হলো হ্যাঁ, অলিম্পিকেও ক্রিকেট হয়েছিল। যেন পানির সাথে তেলের মিলে মিশে একাকার হওয়ার গল্প।
আপনি-আমি দেখিনি তবে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় অলিম্পিকে ক্রিকেট হয়েছিল। এ ইভেন্টের স্বর্ণপদকজয়ী দলের নাম ক্রিকেটের জনক গ্রেট ব্রিটেন। তবে ঘটনাটি এক কিংবা দুই বছর আগের নয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে ১৯০০ সালের প্যারিস অলিম্পিকের ঘটনা।
১৯০০ সালে প্যারিস অলিম্পিকে স্বর্ণপদকের লড়াইয়ে ছিল চার ইউরোপিয়ান দেশ। তবে শেষ পর্যন্ত স্বর্ণ পদকের লড়াইয়ে আসে মাত্র দুইটি দল। তাই ব্রোঞ্জজয়ী দলের নাম পাওয়া যায়নি।
অলিম্পিকে ক্রিকেটে ইভেন্টে নাম থাকা দেশগুলোর মধ্যে একমাত্র গ্রেট ব্রিটেনেই ক্রিকেট পরিচিত খেলা। অন্যদেশগুলোতে ক্রিকেট হলো অপরিচিত এক খেলা । গ্রেট ব্রিটেন বাদে ক্রিকেট ইভেন্টে থাকা বাকি দেশগুলো হল ফ্রান্স,বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ড। নেদারল্যান্ড ক্রিকেট বিশ্বে কিছুটা পরিচিতি রাখলেও ফ্রান্স কিংবা বেলজিয়াম ক্রিকেট দুনিয়ায় কোনো পদচিহ্নই রাখেনি।
১৯০০ সালে ওয়ানডে কিংবা টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সাথে দুনিয়ার পরিচয় না থাকায় অলিম্পিকের জন্য টেস্ট ম্যাচই আয়োজন করা হয়েছিল। সূচি অনুযায়ী চারটি ম্যাচ হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছিল মাত্র একটি ম্যাচ।
যাই হোক অলিম্পিকের সূচিটা ছিল ঠিক এরকম
- আগস্ট (৪-৫): ফ্রান্স বনাম বেলজিয়াম
- আগস্ট (১১-১২): ফ্রান্স বনাম নেদারল্যান্ড
- আগস্ট (১৯-২০): ফ্রান্স বনাম গ্রেট ব্রিটেন
সূচিতে থাকা তিন ম্যাচের মধ্যে একটি ম্যাচই মাঠে গড়িয়েছিল। বাকি দুই ম্যাচ মাঠে গড়ায়নি। এ কারণেই এই ম্যাচটিই হয়ে আছে অলিম্পিকের ইতিহাসের একমাত্র ক্রিকেট ম্যাচ। আর সে ম্যাচে জিতেই অলিম্পিকের ক্রিকেট ইভেন্টের প্রথম এবং একমাত্র স্বর্ণপদক জয় করে গ্রেট ব্রিটেন।
বেলজিয়াম কিংবা নেদারল্যান্ড দুই দলেরই অলিম্পিকে খেলার কথা ছিল। তবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে দল গঠন করতে না পারায় মাঠে নামতে পারেনি ইউরোপিয়ান এ দুই দল। ফ্রান্স যে ঠিক মাঠে দল নিয়ে নামতে পেরেছিল তা বলা যায় না। কারণ ফ্রান্স দলের সব সদস্যই ছিল ইংলিশ শ্রমিক।
ইয়ান বুকানন তার বই ক্রিকেট অ্যাট দ্য ১৯০০ গেমস বইয়ে জানিয়েছিলেন, ‘মূলত দুইটি ক্লাবের ক্রিকেটারদের নিয়ে ফ্রান্স দল গঠন করা হয়েছিল। ক্লাব দুইটি ছিল ডিফ্যাঙ্কট ইউনিয়ন ক্লাব এবং স্ট্যান্ডার্ড স্পোর্টিং ক্লাব।’
ক্লাবের সদস্যরা ছিলেন বেশিরভাগ ইংলিশ নাগরিক। প্যারিসের আইফেল টাওয়ার নির্মাণের উদ্দেশ্যে আসা শ্রমিকরা এ ক্লাব দুইটি গঠন করেছিলেন এবং তারা ক্রিকেট খেলতেন। তাদেরকে নিয়েই গঠন করা হয়েছিল ফ্রান্সের অলিম্পিক মিশনের ক্রিকেট দল।
তবে ১৮৯৬ সালে এথেন্স অলিম্পিকেই প্রথমবারের মত ক্রিকেট ইভেন্ট হওয়ার কথা ছিল। তবে পর্যাপ্ত অংশগ্রহণকারী না থাকায় তা আর হয়নি। তবে চার বছর পর প্যারিস অলিম্পিকে ক্রিকেটের দেখা মিলেছিল। তবে এ আসরই ছিল প্রথম এবং একমাত্র অলিম্পিক আসর যেখানে ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়েছিল।
- ম্যাচ বিবরণী
দিনের প্রায় ১১ টার দিকে মাঠে গড়িয়েছিল অলিম্পিক ইতিহাসের প্রথম এবং একমাত্র ক্রিকেট ম্যাচ। এ ম্যাচ দেখার জন্য হাজির হয়েছিলনে দুই দলের ক্রিকেটারদের থেকেও কম সংখ্যক দর্শক।
প্রথমদিনে ব্যাটিংয়ে নামে গ্রেট ব্রিটেন। আর ব্রিটেনের হয়ে ইনিংসের গোড়াপত্তন করেন অধিনায়ক চার্লস বেইচি কে বিচক্রফট এবং আর্থার বেরিংটন বেরকেট। আর ফ্রান্সের হয়ে বোলিং শুরু করেন উইলিয়ামস অ্যাটরিল এবং অ্যান্ডারসন।
প্রথমদিনের খেলার সময় দুপুরে দিকে এক ঘন্টার মধ্যাহ্ন বিরতি পালন করে দুই দল। মধ্যাহ্ন বিরতির পর বেলা বাড়ার সাথে সাথে মাঠে উৎসুক জনতার ঢল নামে। ব্যাট হাতে প্রথম ইনিংসে ভালো শুরু করতে পারে নাই গ্রেট ব্রিটেন, মাত্র ১১৭ রানে সব উইকেট হারায়। ফ্রেডেরিক কামিং দলের হয়ে সর্বোচ্চ ৩৮ রান করেন। ফ্রান্সের হয়ে অ্যান্ডারসন চার উইকেট শিকার করেন। ফ্রান্সের অপর দিন বোলার অ্যাটরিল আর্থার, ম্যাকভয় এবং ডগলাস রবিনসন দুইটি করে উইকেট শিকার করেন।
গ্রেট ব্রিটেনের ১১৭ রানের জবাবে ফ্রান্সও খুব আকাশচুম্বী কিছু করেছেন সেটা আবার কেউ ধারণা করবেন না। ফ্রান্স অলআউট হয়েছে মাত্র ৭৮ রানে। গ্রেটন ব্রিটেনের স্ট্যাফফোর্ডশায়ারের ২৩ বছর বয়সী পেসার ফ্রেডেরিক ক্রিস্টিয়ান ফ্রান্সের সাত উইকেট শিকার করেছিলেন। আর বাকি তিন উইকেটের মধ্যে দুই উইকেট শিকার করেছিলেন জন পোলেসল্যান্ড।
ফ্রান্সের ৭৮ রানের মধ্যে টপ অর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানের সংগ্রহ ছিল ৩৪ রান। যার মধ্যে অতিরিক্ত রান থেকে এসেছিল ১১ রান। ফ্রান্সের হয়ে সর্বোচ্চ ২৫ রান করেছিলেন ১২তম ব্যাটসম্যান ব্রেইড।
ফরাসি ব্যাটসম্যান ব্রেইড রান আউট হলেও অপর প্রান্তে ৩ রানে অপরাজিত ছিলেন অধিনায়ক ফিলিপ টোমালিন। ব্রেইড রান আউট হওয়ার মাধ্যেম ৩৯ রানের বিশাল লিড পেয়ে যায় ইংল্যান্ড। ফরাসি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে ৫ থেকে ৯ নম্বরে ব্যাট করা এফ রকস, অ্যান্ডারসন, ডগলাস রবিনসন, অ্যাটরিল আর্থার এবং ডব্লিউ ব্রাউনিং সবাই রানের খাতা খোলার আগেই প্যাভিলিয়নে ফিরে যান।
৩৯ রানের বড় লিড নিয়ে দ্বিতীয় দিনের খেলা শুরু করে গ্রেট ব্রিটেন। প্রথম ইনিংসে ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় ইনিংসে ঘুরে দাঁড়ায় গ্রেট ব্রিটেন। ওপেনার বেইচি বিচক্রাফট এবং বোয়ারম্যান দুইজনই অর্ধশতকের দেখা পান। তারা দুইজনে ব্যাট হাতে করেন যথাক্রমে ৫৪ এবং ৫৯। দ্বিতীয় ইনিংসে পাঁচ উইকেটে দলীয় ১৪৫ রানের মাথায় ইনিংস ঘোষণা করে ব্রিটিশ অধিনায়ক বিচক্রাফট। দ্বিতীয় ইনিংসে ফ্রান্সের হয়ে ৩ উইকেট শিকার করেন এফ রকস।
দ্বিতীয় ইনিংসে ফ্রান্সের সামনে জয়ের জন্য লক্ষ্য দাঁড়ায় ১৮৫ রান। হয়তো সহজেই জয়ের বন্দরে পৌঁছাতে পারতো ফ্রান্স, তবে মাত্র ২৬ রানে অলআউট হয়ে যায়। আর ১৫৮ রানের পরাজয় নিশ্চিত করে। ব্রিটেনে হয়ে মন্টাগু টলার ৯ রানে ৭ উইকেট শিকার করেন আর পোলেসল্যান্ড ৩ উইকেট শিকার করেন।
- স্বর্ণপদক জয়ী দল
গ্রেট ব্রিটেন: বিচে বিচক্রাফট, আর্থার বিরকেট, জন সিমস, ফ্রেডেরিক কামিং, মন্টাগু টলার, আলফ্রেড বোয়ারম্যান, আলফ্রেড পোলেসল্যান্ড, উইলিয়াম ডোনে, ফ্রেডেরিখ ক্রিস্টিয়ান, জর্জ বাকলে, ফ্র্যান্সিস বুরচেল, হ্যারি কর্নার।
- রৌপ্য পদকজয়ী দল
ফ্রান্স: ফিলিপ টোমালিন, টিমোথ এ জর্ডান, আর্থার শিনেইদু, রবার্ট হর্ন, হেনরি টেরি, এফ রকস, উইলিয়াম অ্যান্ডারসন, ডগলাস রবিনসন, উইলিয়াম অ্যাটরিল, ডাব্লিউ ব্রাউনিং, আর্থার ম্যাকভয়, যে ব্রেইড।
স্বর্ণপদকজয়ী দলের সদস্যদের সবাইকে আইফেল টাওয়ারের মনুমেন্ট উপহার হিসেবে দেওয়া হয়। ১৯১২ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি গঠন হওয়ার আগের অলিম্পিককে আধুনিক কিংবা অফিসিয়াল অলিম্পিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। এ কারণেই এ অলিম্পিক অনুষ্ঠিত হওয়া ক্রিকেট ইভেন্টকে অফিসিয়াল হিসেবে গণ্য করা হয় না।
১৯৯০ সালে স্ট্যান্ডার্ড স্পোর্টিং ক্লাবের ৯০ বছর পূর্তি উপলক্ষে গ্রেট ব্রিটেনের একটি দল ফ্রান্স সফর করেছিল। সেখানে দুই দিনের একটি ম্যাচ অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে দুই দলের মধ্যে অনুষ্ঠিত ম্যাচে আবারও গ্রেট ব্রিটেন জয় লাভ করে। এ কারণে বলা হয় অলিম্পিক ক্রিকেটের স্বর্ণপদক জয়ী দল গ্রেট ব্রিটেন।