টার্বুনেটরের সাম্রাজ্যে

চিত্রপট এক। ২০০৩ সালের ২৩ মার্চের সন্ধ্যা।

দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ভারতীয় সমর্থকদের জন্য নেমে এসেছিল দু:স্বপ্ন, যা হয়তো হতে পারতো আনন্দঘন রাত। ২০ বছর পর আবার বিশ্বজয়ের যে স্বপ্ন ভারতীয় সমর্থকরা দেখেছিল তা বাস্তবায়ন করতে পারেননি এক অকুতোভয়, বাঙালি দামাল ছেলের অধিনায়কত্বে। সেদিন কিছু প্রশ্ন উঠেছিল, যা ছিল স্বাভাবিক।

সেই সবের মধ্যে অন‍্যতম ছিল অনিল কুম্বলের মতো একজন অভিজ্ঞ স্পিনারকে দলের বাইরে রেখে এক তরুণ স্পিনারকে প্রথম একাদশে রাখা নিয়ে। সেই বিশ্বকাপে ভারতীয় পেসাররা অসাধারণ ছিল, আর তরুণ স্পিনারও দক্ষিণ আফ্রিকার পিচে ফাইনালের আগে ৯ ম্যাচে ৯ উইকেট নিয়েছিলেন, তাই ফাইনালে তাঁর থাকা নিয়ে কোনো প্রশ্ন উঠবার কথা নয়। ফাইনালে সেদিন অস্ট্রেলিয়া ব্যাটিংয়ে অসামান্য ছিল, ভারতীয় পেসাররাও তেমন কিছু করে উঠতে পারেননি তবে ওই স্পিনার ২ টি উইকেট পেয়েছিলেন যদিও তা কোনো কাজে লাগেনি।

চিত্রপট দুই। ২০১১ সালের দুই এপ্রিলের রাত।

আরব সাগরের তীরে ওয়াংখেড়েতে ভারতীয় সমর্থকদের আর বুক ভাঙেনি। ঘরের মাঠে তরুণ তুর্কী এক অধিনায়কের অধিনায়কত্বে তরুণ ভারতীয় দলের সাথে ক্রিকেটের ঈশ্বর ওই বিশ্বকাপের সোনালী ট্রফিতে স্পর্শ করবার সুযোগ পেয়েছিল। ২৮ বছর পর আবার সীমিত ওভারের ক্রিকেটের বড় ফরম্যাটে  আবার বিশ্বজয় খেলোয়াড় সহ গোটা ভারতবর্ষকে আবার উদ্বেলিত করেছিল।

আর আট বছর আগের সেই অফি সেদিন দলের গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞ খেলোয়াড়। ওইদিনও অসাধারণ পারফরম্যান্স দিয়েছিল গোটা টুর্নামেন্টের মতোই। হরভজন ‘টার্বুনেটর’ সিং যে বরাবর ভারতীয় দলের এক অনন্য সেনানী তা বারবারই প্রমাণ করেছেন এবং তা শুধু দেশের মাটিতে নয়, বিদেশের মাটিতেও।

২০০ সালে ম্যাচ গড়পেটা কাণ্ডের পর, সৌরভ গাঙ্গুলী দায়িত্ব নেওয়ার পর যেই সিরিজ ভারতীয় ক্রিকেটের রূপরেখা পাল্টে দিয়েছিল সেই ভারত-অস্ট্রেলিয়া মহাকাব্যিক সিরিজে টার্বুনেটর একাই অস্ট্রেলিয়ার অমন শক্তিশালী ব্যাটিং লাইন আপকে গুড়িয়ে দিয়েছিল যার মধ্যে সেই ইডেন টেস্টও ছিল।

কিন্তু ঘটনা হলো সেই বিখ্যাত সিরিজ হয়তো খেলাই হয় না যদিনা আমাদের কিংবদন্তি অনিল কুম্বলে সিরিজের আগে চোট পান। আর তা না হলে হয়তো টার্বুনেটর আমরা পেতামই না, তিনি হয়তো কানাডা কিংবা যুক্তরাষ্ট্রতে ট্রাক চালাতেন।

একজন অফ স্পিনারের যতগুলো অস্ত্র দরকার তার প্রায় সবই তার তূণীরে ছিল। অসাধারণ বোলিং অ্যাকশনের সাথে ধ্রুপদী অফ স্পিনের সাথে দুসরা, তিসরা কিংবা অসাধারণ পেসের সাথে স্পিন সবকিছুই তাঁকে অসাধারণ বানিয়ে দিয়েছে।

উপমহাদেশের স্পিনার তাই উপমহাদেশের উইকেটে সাফল্য পাবেন এ তো জানা কথা কিন্তু শুধু তা দিয়েই ১০০ এর বেশি টেস্টেও খেলা যায় না কিংবা ৪০০ এর বেশি উইকেটও পাওয়া যায় না।

হ্যাটট্রিক সহ ইডেনে সেই ঐতিহাসিক টেস্টে সাত উইকেট, ইডেনেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৭ উইকেট, সাবাইনা পার্কে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে ৫ উইকেট, হ্যামিল্টনে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৬ উইকেট, নিউল্যান্ডসে দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে ৭ উইকেট – বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন পিচে উইকেট তুলে নিতে পারায় তাকে বিশ্বের অন‍্যতম মহান বানিয়ে দিয়েছে।

তাও তো ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে কুম্বলের ছত্রছায়ায়, দলের দ্বিতীয় স্পিনার হিসেবে। তাঁর বোলিংয়ে তো সবাই মুগ্ধ হতোই, কিন্তু তার ব্যাটিং আমাদের কাছে সব সময় সময় একটা উপভোগ‍্য বিষয় ছিল বিশেষ করে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। টেস্টে তার টেকনিক বলবার মতো ছিল না কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ সময়ে গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেলতেন।

নয় নম্বরে নেমে টানা দুটি টেস্টে শতরান করে রেকর্ডও গড়েছেন। অন‍্যদিকে, ক্যারিয়ারের একটা সময় বোলিংয়ের অ্যাকশনের জন্য বহু বার বিতর্কের মধ্যে পড়েছেন, যেমন মানুষ হিসেবেও মাঠে ও মাঠের বাইরেও বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন। যদিও, বিতর্ক ছাপিয়ে বারবারই আলোচিত-প্রশংসিত হয়েছে তাঁর ফিরে আসার চেষ্টা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link