প্রস্তুত ইউরোর ফাইনালের মঞ্চ। উত্তেজনার পসরা সাজিয়ে অপেক্ষা করছে ওয়েম্বলি স্টেডিয়াম। এক বছরের অপেক্ষার প্রহর শেষে ওয়েম্বলির সবুজ ঘাসেই মুখোমুখি হবে ইতালি আর ইংল্যান্ড। প্রস্তুত দুই কোচ রবার্তো মানচিনি ও গ্যারেথ সাউথগেট। লড়াই চলবে তাঁদের মাঝেও। খেলোয়াড়ি জীবনের অপ্রাপ্তি ঘুচানো, নিজেদের কৌশলগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করা – লড়াইয়ের মধ্যে আবার টুকরো টুকরো অনেক যুদ্ধও আছে।
অথচ দুই বছর আগেই ইতালির ফুটবলের শেষ দেখে ফেলেছিলেন সবাই। বিশ্বকাপের বাছাইপর্বই পেরোতে পারেনি ইতালি। সাথে সাথে বরখাস্ত হন কোচ জিয়ান পিয়েরো ভেন্তুরা, পদত্যাগ করেন ফুটবল ফেডারেশনের প্রধান। বিদায় নিলেন দীর্ঘদিনের কান্ডারি বারজাগলি, কিয়েলিনি, ডি রসি, বুফনরা। তিনমাস খালি ছিল কোচের পদ, ভঙ্গুর এক দলের দায়িত্ব নিতে চাননি কেউই। অবশেষে রাজি হলেন একজন, ইতালিরই অভিমানি এক সন্তান।
বিখ্যাত কোচ আরিগো সাচ্চি যাকে এক মিনিটের জন্য মাঠে নামাননি ১৯৮৮ ইউরোতে, পরবর্তীতে এর জের ধরে আর কখনো ডাক পাননি জাতীয় দলেই। আজ্জুরিদের নীল জার্সি গায়ে জড়াতে না পারার আক্ষেপ তার আজন্ম। কিন্তু ইতালির দুর্দশার সময়ে আর ফেরাতে পারলেন না, অভিমান ভেঙে তাই ফিরলেন কোচের দায়িত্বে। লক্ষ্য একটাই খেলোয়াড়ি জীবনে যা পারেননি ডাগআউটে থেকে সেটাই করা, ইতালির শ্রেষ্ঠত্ব ফিরিয়ে আনা।
তাঁর ছোঁয়াতেই ভোজবাজির মতো পালটে গেল ইতালির অবস্থা, ফিরিয়ে আনলেন কিয়েলিনিকে। নিয়মিত করলেন আগের কোচের অধীনে সুযোগ না পাওয়া ইনসিগনে-ইম্মোবিলেদের, বুফনের রেখে যাওয়া গ্লাভস তুলে দিলেন ডোনারুম্মার হাতে। ভেরাত্তি, বনুচ্চি, ডি লরেঞ্জো, স্পিনাৎজোলাদের পাশাপাশি সু্যোগ জর্জিনহো, লোকাতেল্লি, বারেল্লা, কিয়েসা, সেনসি, পেসিনাদের।
ইউরোর বাছাইপর্ভের দশ ম্যাচের সবকটিতেই জিতলো তার দল, ১০ ম্যাচে প্রতিপক্ষের জালে ৩৭ গোল দেবার পাশাপাশি হজম করেছে মাত্র দুইটি। টানা ৩৩ ম্যাচ ধরে অপরাজিত মানচিনির এই নতুন ইতালি। যা ইতোমধ্যেই ভেঙে দিয়েই ৮৮ বছরের পুরনো ভিক্টোরিও পুজ্জোর বিখ্যাত ইতালির রেকর্ড, চোখ রাঙালে ব্রাজিলের ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত থাকার রেকর্ডকে।
শুরু থেকেই ইতালি বিখ্যাত তার রক্ষণভাগের কারণে, পাঁচ ডিফেন্ডারে নিজেদের গোললাইন ব্লক রেখেই জিতেছে চারটি বিশ্বকাপ। কিন্তু মানচিনি এসেই বুঝলেন পুরনো ধারা বদলাতে হবে, যুগের গতিশীল ফুটবলের সাথে পাল্লা দিতে আক্রমণাত্নক প্রেসিং ফুটবলের বিকল্প নেই। দলকে খেলাতে শুরু করলেন ৪-৩-৩ ফর্মেশনে।
গোলবারে ডোনারুম্মার সামনে দুই ভেটেরান কিয়েলিনি-বনুচ্চি জুটি। দুই উইংব্যাকে স্পিনাৎজোলা আর ডি লরেঞ্জো। স্পিনাৎজোলা আক্রমণে বেশি মনোযোগি থাকলেও ডি লরেঞ্জো কিছুটা রক্ষণাত্নক। তাদের সামনে প্রতিপক্ষের দুই ডিফেন্সিভ ঘরানার মিডফিল্ডার জর্জিনহো আর ভেরাত্তি। এদের মাঝে জর্জিনহো মূলত রেজিস্তা, বল পায়ে অত্যন্ত সাবলীল এই মিডফিল্ডার প্রতিপক্ষের আক্রমণ নস্যাৎ করার পাশাপাশি পেছন থেকে খেলা তৈরির কাজটা করে থাকেন।
তার পাশে থাকা ভেরাত্তি মূলত বক্স টু বক্স মিডফিল্ডার, ক্রমাগত উপর-নিচ উঠানামা করে খেলতে থাকেন। তাদের দুজনের কিছুটা সামনে খেলেন ইন্টার মিলানের নিকোলো বারেল্লা। বারেল্লার কাজ মূলত ফরোয়ার্ডদের বল সরবরাহ করা। অন্যদিকে আক্রমণভাগের সামনে খেলে থাকেন ইনসিগনে-ইম্মোবিলে-কিয়েসা জুটি।
উইংয়ের পাশাপাশি কাট করে ভেতরে ঢুকে দারুণ ফিনিশ করতে পারদর্শী দুই উইংগারই। অন্যদিকে ইম্মোবিলে পারফেক্ট পোচার, বক্সের আশেপাশেই বেশি থাকেন। ইতালির বেঞ্চও সমান শক্তিশালী, রয়েছে নানা বৈচিত্র্যতা। আসেরবি, তোলোই, বাস্তোনি, ফ্লোরেনজি, লোকাতেল্লি, পেসিনা, বেলোত্তি, বেরার্ডিরা যাকে কিনা বদলি হিসেবে খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিতে সক্ষম।
অন্যদিকে এক দশক পর আবারো ল্যাম্পার্ড-জেরার্ড-রুনিদের গোল্ডেন জেনারেশনের যোগ্য উত্তরসূরী পেয়েছে ইংল্যান্ড। একঝাঁক তরুন প্রতিভাকে গড়ে তোলার জন্য থ্রি লায়ন্স ড্রেসিংরুমে দরকার ছিল এমন এক চরিত্র যিনি কিনা খেলোয়াড়দের সাথে মিশবেন বন্ধুর মতো আবার প্রয়োজনবোধে কঠোর হতে দ্বিধাবোধ করবেন না।
সবকিছু বিবেচনায় দায়িত্ব পান সাবেক ইংলিশ ফুটবলার গ্যারেথ সাউথগেট। সাউথগেট নিজে ছিলেন সেই গোল্ডেন জেনারেশনের অংশ, জানতেন কোন জায়গায় ব্যর্থ ছিলেন সভেন গোরান এরিকসন-ক্যাপেলোরা। চিরায়ত ৪-৪-২ ফর্মেশন থেকে বেরিয়ে এসে দলকে তৈরি করলেন ফ্রি ফ্লোয়িং ফুটবলে।
তার ইংল্যান্ড যেকোনো সময় যেকোনো কৌশলে মানিয়ে মিতে সক্ষম। ফলাফলও মিললো হাতেনাতেই, ২০১৮ বিশ্বকাপে সেমিফাইনালে উঠে ইংল্যান্ড। সেবার অতিরিক্ত সময়ের গোলে হারলেও এবার আর ভুলে করেননি সাউথগেটের শিষ্যরা, সেমিফাইনাল গেঁরো কাটিয়ে উঠেছে ফাইনালেই।
হ্যারি ম্যাগুয়েরের অনুপস্থিতিতে টুর্নামেন্টের শুরুর দিকে ৩-৫-২ ফর্মেশনে শুরু করলেও ম্যাগুয়ের ফিরে আসতেই সাউথগেট ফিরে গেছেন ৪-২-৩-১ ফর্মেশনে। সমালোচনা থাকলেও তিন কাঠির নিচে সাউথগেট ভরসা রেখেছেন জর্ডান পিকফোর্ডের উপর।
সেই আস্থার কি দারুণ প্রতিদানই দিচ্ছেন তিনি, টুর্নামেন্টে এখনো পর্যন্ত কেবল এক গোল হজম করেছে থ্রি লায়ন্সরা। ডিফেন্সের চার পজিশনের মাঝে তিন পজিশনেই জায়গা ফিক্সড। সিবি ডুয়ো ম্যাগুয়ার-স্টোন্সের পাশে ডানপাশে খেলবেন কাইল ওয়াকার।
সাউথগেট সবচেয়ে বেশি পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন বোধহয় ডিফেন্সের এই বামপ্রান্ত নিয়েই। কখনো চিলওয়েল আবার কখনো ট্রিপিয়ারকে মেকশিফট বানানোর চেষ্টা ক্ষান্ত দিয়ে অবশেষে স্থিতি হয়েছেন লুক শ’তে। সামনে দুই ডিফেন্সিভ ডুয়ো ডেকলান রাইস-ক্যালভিন ফিলিপ্স। ডিফেন্সে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি দূরপাল্লার আচমকা শোতে গোল করতে ওস্তাদ দুজনেই।
তাঁদের সামনে খেলেন স্টার্লিং-মাউন্ট-সাকা/সানচো। এদের মাঝে স্টার্লিং আর মাউন্ট খেলেন পুরোপুরি ফ্রি রোলে, ইংল্যান্ডের আক্রমণ দানা বাঁধে তাদের পায়েই। সবার সামনে লোন স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেন কাপ্তান হ্যারি কেইন। এছাড়াও বেঞ্চে আছেন গ্রিলিশ, বেলিংহাম, রাশফোর্ড, কালভার্ট লুইন, ফোডেনের মতো ফুটবলাররা।
দুই দলের কোচেরই মাথাব্যথা থাকবে নিজেদের ডানপাশ নিয়ে। কারণ দুই দলের লেফট উইংগারই আছেন নিজেদের সেরা ফর্মে। রাহিম স্টার্লিং আর লরেঞ্জো ইনসিগনে দুজনেই এবারের ইউরোর ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্টের সবচেয়ে বড় দাবিদার। এছাড়াও মানচিনির মাথাব্যথার কারণ হতে পারেন হ্যারি কেন, গ্রুপপর্বে গোলের দেখা না পেলেও নকআউটের প্রতিটি ম্যাচেই কেইন গোল পেয়েছেন।
তাকে আটকানোটা বড় চ্যালেঞ্জ কিয়েলিনি-বনুচ্চির। তবে সাউথগেট দুশ্চিন্তায় থাকবেন ওয়েম্বলিতে কিয়েসার দুর্দান্ত ফর্ম নিয়ে। এমনিতেই তার বাঁমপ্রান্তটা নড়বড়ে, লুক শ কিংবা স্টার্লিং দুজনেই রক্ষণের চাইতে আক্রমণেই বেশি মনোযোগী। অন্যদিকে কিয়েসা আছেন ওয়েম্বলিতে অসাধারণ ফর্মে, বাবার দেখানো পথে গোল পেয়েছেন ওয়েম্বলিতে খেলা শেষ দুই ম্যাচেই। তবে মানচিনি চিন্তায় থাকবেন তার মূল স্ট্রাইকার ইম্মোবিলের গোলখরা নিয়ে।
বহু প্রতীক্ষার পর শিরোপা খরা কাটিয়ে ফাইনালে উঠেছে দুই দলই। কার অপেক্ষার প্রহর আরো দীর্ঘ হবে আর কারা মাতবে শিরোপা জয়ের উল্লাসে সেজন্য অপেক্ষা কেবল সোমবারের মহারণের।