দৃশ্যপট এক।
১৪ জুলাই, ২০১৪। ২৪ বছর বাদে সেবার আর্জেন্টিনা উঠেছিল বিশ্বকাপের ফাইনালে। লিওনেল মেসির সামনে সুযোগ এসেছিলো অবিসংবাদিত সেরা হবার। মঞ্চ প্রস্তুত, বিজয়ী হিসেবে মেনে নিতে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন সবাই। দলের ফাইনালে উঠার লড়াইয়ে প্রতিটি ম্যাচে তিনি ছিলেন প্রথম একাদশে। অথচ ফাইনাল ম্যাচের স্কোয়াডেই নেই তিনি।
সেমিফাইনালে হালকা ব্যথা পেয়েছিলেন, সেটাই কাল হয়ে দাঁড়াল। কয়েকদিন আগেই রিয়া মাদ্রিদের দশ বছরের অপেক্ষা ঘুচিয়ে তিনি জিতিয়েছেন লা ডেসিমা। দলবদলের বাজারে তাকে নেয়ার জন্য জোর লড়াই। এমন সোনার ডিম পাড়া হাঁসের দাম কমে যেতে পারে ভেবে তাকে খেলতে দিল না রিয়াল মাদ্রিদ। অথচ তিনি শুধু খেলতে চেয়েছিলেন, ব্যথানাশক ইনজেকশন নিয়েছিলেন খেলার জন্য।
শুধুমাত্র এই দিনটির জন্য বিনিদ্র জেগেছিলেন কত রাত, করেছেন ত্যাগতীতিক্ষা। সবাই ফিরে গেলেও একা একা করেছেন অনুশীলন, রোজারিওর সবাইকে যে কথা দিয়েছিলেন আকাশি-সাদা জার্সিতে জিতবেন শিরোপা। তিনি কাঁদলেন ম্যাচের আগে, ম্যাচ হেরে গেলেন মেসিরা। তার কান্না আরো দীর্ঘায়িত হল, তার কান্নাভেজা মুখ দেখে অশ্রুসিক্ত হলেন লক্ষ-কোটি সমর্থক।
দৃশ্যপট দুই।
১১ জুলাই, ২০২১। সেই ফাইনাল হারার পর কেটে গেছে সাত বছর। মাঝে আর্জেন্টিনা হেরেছে আরো দুই কোপার ফাইনাল। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, এর কোনোটিতেই পুরো সময় মাঠে ছিলেন না তিনি। বাইরে থেকেই দীর্ঘায়িত হয়েছে আক্ষেপ।
এত বছর পেরিয়ে আরো একবার কোপা আমেরিকার ফাইনালে আর্জেন্টিনা। এবারো তার ফাইনালে খেলা শংকা, টুর্নামেন্টের কোনো ম্যাচেই ছিলেন না শুরুর একাদশে। বড় অঘটন না ঘটলে ফাইনালেও একাদশে থাকার সম্ভাবনা ক্ষীণ। কিন্তু অঘটনটা ঘটেই গেলো, কোচ লিওনেল স্ক্যালোনিকে অনুরোধ করলেন। কোচ রাজি হলেন, ফাইনালে মাঠে নামলেন তিনি। কিন্তু কেবল মাঠে নামলেই চলবে না, দলকে তো জেতাতে হবে।
রোজারিওর মানুষের যে তার প্রতি অনেক আশা। ২২ মিনিটের সময় দি পলের পাসে লোদির ভুলে বল পেয়ে গেলেন। ঠিক একই পরিস্থিতিতে সাত বছর আগে মিস করেছিলেন বন্ধু হিগুয়েইন। সেসময় কি তার মাথায় হিগুয়েইনের চেহারাটা ভেসে উঠছিলো না! তিনি সেসবের থোড়াই কেয়ার করলেন।
বাঁ পায়ে দারুণভাবে বলটা রিসিভ করলেন এরপর ডানপায়ের আলতো ছোঁয়ায় এডারসনের মাথার উপর বলকে এঁকে দিলেন গোলের ঠিকানা। তাকিয়ে থাকা ছাড়া কিছুই করার ছিল না গোলরক্ষক আর স্টেডিয়ামে উপস্থিত থাকা হাজার পাঁচেক দর্শকের। তার একমাত্র গোলেই ২৮ শিরোপা খরা কাটালো আর্জেন্টিনা।
তিনি অ্যাঞ্জেল ডি মারিয়া। কারো কারো ভাষায় অ্যানহেল ডি মারিয়া। কিন্তু, আর্জেন্টিনার জন্য তো তিনি সত্যিই এক অ্যাঞ্জেল।
১৯৮৮ সালে ভালোবাসা দিবসের দিনে মিগুয়েল এবং ডায়ানা দম্পতির ঘর আলো করে আগমন ঘটে এক দেবদূতের। বাবা নাম রাখেন অ্যাঞ্জেল ফাবিয়ান ডি মারিয়া। ছোটবেলাতেই দারুণ চঞ্চল ডি মারিয়া, এজন্যই কিনা ডাক্তার পরামর্শ দিলেন বাচ্চাকে ব্যস্ত রাখার, মার্শাল আর্ট কিংবা ফুটবলে মনোযোগি হবার।
কিন্তু, মারিয়ার বাবার আয় ছিল অতি সামান্য, ফুটবল একাডেমিতে ভ্ররতি করানোর সামর্থ্য ছিল না তাদের। এমনকি কিনে দিতে পারেননি ফুটবল বুটও। কিন্তু প্রতিভাকে কি আর অর্থাভাব চাপা রাখতে পারে, চার বছর বয়সেই নজরে পড়ে যান স্থানীয় ক্লাব রোজারিও সেন্ট্রালের।
এরপরের যাত্রাটা সুখের, রোজারিও কাঁপিয়ে একসময় ঢুকে যান পেশাদার ফুটবল জগতে। ম্যারাডোনা স্বয়ং তার প্রশংসা করেন। কানাডায় ২০০৭ সালের ফিফা অনুর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে জেতান শিরোপা। এরপরই ইউরোপিয়ার ফুটবলে কাড়াকাড়ি লেগে যায় তাকে নিয়ে। আর্সেনাল-চেলসিকে টেক্কা দিয়ে তাকে দলে ভেড়ায় বেনফিকা। বেনফিকার হয়ে তিন মৌসুমে ১২৪ ম্যাচে করেন ১৫ গোল।
২০১০-১১ মৌসুম, স্পেনে তখন পেপ গার্দিওলার বার্সার রাজত্ব। লা লিগা কিংবা চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সবখানেই খাবি খাচ্ছে রিয়াল মাদ্রিদ। ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের প্রজেক্ট গ্যালাকটিকো ব্যর্থ হয়েছে বাজেভাবে। সেই মৌসুমে হতাশা ভুলতে তাই মারিয়াকে দলে ভেড়ায় মাদ্রিদ। হতাশ করেননি মারিয়া, প্রথম মৌসুমেই মাদ্রিদকে এনে দেন লা লিগার শিরোপা। ৩৫ ম্যাচে নয় গোল করে দলকে নেতৃত্ব দেন সামনে থেকে।
কিন্তু, অধরা ছিল চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা, সেটাও দূর করে দিলেন ডি মারিয়া। লিসবনের সেই ফাইনালও ছিল মারিয়াময়, নিজে গোল না করলেও মাদ্রিদের গোলেই ছিল তার অ্যাসিস্ট। তার গতি-ড্রিবলিং সামলাতে না পেরেই হাল ছেড়ে দেয় অ্যাতলেটিকো মাদ্রিদ।
কিন্তু, বিশ্বকাপের ফাইনালের আগে মাদ্রিদের বিমাতাসুলভ আচরণের জন্য সে মৌসুমেই মাদ্রিদ ছেড়ে পাড়ি জমান ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড়ে। যদিও তার ইউনাইটেড অধ্যায়টা তেমন সুখকর হয়নি। সেখানে এক মৌসুম খেলেই তাই চলে আসেন প্যারিস সেইন্ট জার্মেইতে। এখনো সেখানে খেলছেন দাপটের সাথেই। প্যারিসের হয়ে ২৬৪ ম্যাচে করেছেন ৮৭ গোল।
২০০৮ সালে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে জাতীয় দলে অভিষেক ঘটে ডি মারিয়ার। এর আগে ২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে আর্জেন্টিনাকে এনে দেন স্বর্ণপদক। ২০১৪ বিশ্বকাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ১১৭ মিনিটে গোল করে দলকে স্মরণীয় এক জয় এনে দেন তিনি। গোল করেছিলেন ২০১৮ বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচেও, তার গোলেই এগিয়ে যায় আলবিসেলেস্তেরা। যদিও সে লিড ধরে রাখতে পারেনি তারা। জাতীয় দলের হয়ে ১১১ ম্যাচে করেছেন ২১ গোল।
সমর্থকরা আজো বিশ্বাস করেন বিশ্বকাপের ফাইনালে সেদন ডি মারিয়া থাকলে জিততো আর্জেন্টিনা। কিন্তু ভাগ্যের লিখন না যায় খন্ডান। মাদ্রিদকে দশ বছর পর উচল জেতালেও সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু ছিলেন রামোস কিংবা রোনালদো। তার অবদানের কথা মনে রাখেনি কেউ। আজকের কোপার ফাইনালের পরও সবার দৃষ্টি লিওনেল মেসির। গোল করেও যেন সবার চোখের আড়ালে ডি মারিয়া। আসলে মারিয়ারা এমনই, নিজের দায়িত্বটা পালন করলেও কখনো চোখে পড়েন না। কিন্তু তারপর দায়িত্বটা পালন করে যান একই ভালোবাসা দিয়ে।