গুনতে গুনতে ফুরোয় দিন

মনে আছে, ‘মেসি বাগদাদ’ ছবির সে সব শিশুদের কথা, যুদ্ধ যাদের সব কেড়েছে, তারাও কিছু মুহূর্ত শান্তি খোঁজে তোমার নামের জার্সি গায়ে চাপিয়ে। একটা পা আর একটা বল নিয়েই তাঁরা নেমে পড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের রাস্তায় একদিন মেসি হবে এই স্বপ্ন নিয়ে। এদের জন্যই না হয় আরো কয়েকটা বছর এভাবেই লড়তে থাকো, সবুজ ক্যানভাসে আঁকতে থাকো নিজের শিল্প। কটাক্ষ কটূক্তি তুলনা সমালোচনা গুলো না হয় চলতেই থাকুক, আর তো কয়েকটা বছর। সময়টা যে ফুরিয়েই এল, কোপা এল, বিশ্বকাপটাও এল বলে!

প্রিয় লিও,

এই যে এই বছর এখন তুমি আবার ঐ নীল-সাদা জার্সি গায়ে কোপা আমেরিকা খেললে, কেন বলো তো? এত বার হেরে যাওয়ার পরও কেন আবার? এবার যে বিধাতা মুখ তুলে তাকাবে, তাঁর আগাম গ্যারান্টি কিই বা ছিল!

স্পেনের জার্সি গায়ে তো খেললে না সুযোগ থাকার পরেও, তা হলে হয়ত বিশ্বকাপটাও হাতে উঠত আর এতবার ব্যর্থতার সম্মুখীন হতে হত না। কি পেলে ঐ নীল-সাদা জার্সিতে, এমনিও তো ঐ দেশেই তোমার মূর্তি ভাঙা হয় , তুমি নাকি জাতীয় সঙ্গীত গাও না তা নিয়ে সমালোচনাও হয়। জানি চেষ্টা করেছিলে, বিশ্বকাপের সোনার বল, কোপার শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের শিরোপাগুলো আজও আছে তোমার বাড়িতে।

কিন্তু, দ্বিতীয়দের কি কেউ মনে রাখে, দু আঙুলে চিড় নিয়ে খেলে শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়ের শিরোপা নিয়েও জোহানেসবার্গের ড্রেসিংরুমে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে থাকা মারাঠীর কথাও কি কেউ মনে রাখত? পুসকাসও পারেননি , ক্রুইফও পারেননি জানো, সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেও শেষ বাধাটা পেরোতে পারেননি।

তুমিও পারোনি সেদিন। আর তোমাদের তিনজনের বিপক্ষেই ছিল জার্মানরা, কাকতালীয়, তাই না? যাক – এবার অন্তত পারলে।

আচ্ছা তোমার কি ক্লান্তি আসেনি এতদিন? এই যে এত পরিসংখ্যানের কচকচি প্রতিদিন, এত আলোচনা – সমালোচনা, অনবরত তুলনা অপর এক জনের সাথে। তুমি তো এসব চাওনি, ব্যক্তিগতভাবে সেরা হতে। ফুটবলটাকে ভালোবেসে খেলে যেতে চেয়েছিলে যেরকম ছোট্টবেলায় খেলতে রোজারিওর রাস্তায়।

কিন্তু, এই যুগটাই যে অন্যরকম, প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রমাণ করে যেতে হবে, সে যতই তুমি সবচেয়ে বেশিবার ব্যালন ডি অর , গোল্ডেন বুট বা অন্য কিছু জেত না কেন। এ যুগে পান থেকে চুন খোসার উপায় নেই, আর সবটুকু দিয়ে দেওয়ার পরও যে সমালোচিত হবে না , এরকম নিশ্চয়তাও নেই। ভাগ্যিস ডিয়েগো এই যুগে খেলেননি, কে জানে হয়ত দেশের হয়ে গোলের পরিসংখ্যান ইত্যাদি বিচার করে ফেসবুকীয় বিজ্ঞরা তাঁকে হয়তো অলিভিয়র জিরুর সাথে তুলনা করে বসতেন!

আমাদের ছোটবেলায় আমরা বেকহ্যামকে দেখেছি, জিদানকে দেখেছি, রোনালদিনহো-রোনালদো নাজারিওদের দেখেছি, ফিগো-রাউলকেও দেখেছি। একজনকে ভালো লাগলে যে অন্যকে খারাপ লাগতেই হবে এরকম ব্যাপার ছিল না। সবাইকে একসাথে ভালোবাসা যেত তখন। রোনালদিনহো-রোনালদোর জন্য ব্রাজিলের খেলা দেখতে বসে জিদানের শিল্পে মুগ্ধ হওয়া যেত।

এই যে কোপার ফাইনালে হারের পর তোমার ক্রন্দনরত ছবি নিয়ে এত মিম হত, আগে এসব ছিল না বিশ্বাস করো। হয়ত ফেসবুকের হহা রিঅ্যাক্টের সাথে পরিচয় ছিল না বলেই বিশ্বকাপ ফাইনালে জিদানের মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়া বা ইউরো হারের পর ফিগোর মুখ দেখে আমাদের মন ভারাক্রান্ত হত, হাসি পেত না।

তবে কি জানো, আর তো কয়েকটা বছর। ঐ নীল-সাদা জার্সিতে আবারও চেষ্টা করে যাও অধুরা স্বপ্ন ছোঁয়ার। কোপা এল, ২৮ বছর পর। বিশ্বকাপ আসবে? কেন নয়!

তুমি হেরে গেলে অনেক মানুষ হারবে, টিটকিরি শুনবে, কিন্তু তুমি হাল ছেড়ে দিলে যে তাদের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণাই শেষ হয়ে যাবে। জানো এই কলকাতার এক সামান্য রিকশাচালক নিজের রিক্সায় নীল-সাদা রঙ করে ফেলে তোমাকে ভালোবাসে। পরিসংখ্যান ইত্যাদি সে বোঝে না, সারাদিনের অক্লান্ত পরিশ্রমের পর রাতে জেগে সে তোমার খেলা দেখে শান্তি পায় ,খুঁজে পায় দৈনন্দিন জীবনের লড়াইয়ের অনুপ্রেরণা।

আর ঐ আফগান বালক , তালিবান রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তোমার জার্সি গায়ে চাপিয়ে নেয় নিষ্পাপ শিশু, যেন এক নতুন লড়াইয়ের স্পর্ধা খুঁজে পায় তোমাকে দেখে। মনে আছে, ‘মেসি বাগদাদ’ ছবির সে সব শিশুদের কথা, যুদ্ধ যাদের সব কেড়েছে, তারাও কিছু মুহূর্ত শান্তি খোঁজে তোমার নামের জার্সি গায়ে চাপিয়ে। একটা পা আর একটা বল নিয়েই তাঁরা নেমে পড়ে যুদ্ধবিধ্বস্ত শহরের রাস্তায় একদিন মেসি হবে এই স্বপ্ন নিয়ে।

এদের জন্যই না হয় আরো কয়েকটা বছর এভাবেই লড়তে থাকো, সবুজ ক্যানভাসে আঁকতে থাকো নিজের শিল্প। কটাক্ষ কটূক্তি তুলনা সমালোচনা গুলো না হয় চলতেই থাকুক, আর তো কয়েকটা বছর। সময়টা যে ফুরিয়েই এল, কোপা এল, বিশ্বকাপটাও এল বলে!

ইতি

– এক সাধারণ ফুটবলপ্রেমী

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...