টেন্ডুলকারের এক জীবন

কয়েক বার খুব কাছ থেকে দেখেছি মানুষটাকে। এক সময় ইচ্ছে ছিলো, একবার একটা ছবি তুলবো। খুব ইচ্ছে ছিলো একটু কথা বলবো। ছবি তোলা বা কথা বলার সাহস হয়নি। একবার সংবাদ সম্মেলনে একটা প্রশ্ন করেছিলাম। এতো ভিড় ছিলো যে, বুঝতে পারেননি, কে প্রশ্ন করেছে। ফলে আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিয়েছিলেন।

১৫ নভেম্বর তারিখটা এই জীবনে আর ভোলা হবে না।

না, তাঁর জন্মদিন নয়। বিবাহবার্ষিকীও নয়। ছেলে-মেয়ের জন্মদিনও এই দিনে নয়। তারপরও এটা তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন তারিখ।

১৯৮৯ সালের এই ১৫ নভেম্বরে করাচি ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে জীবনে প্রথমবারের মতো আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে ব্যাট করতে নেমেছিলেন। তিন দশক ছুয়ে, ২০১৩ সালের এই ১৫ নভেম্বরে মুম্বাইতে জীবনে শেষবারের মতো ব্যাট হাতে উইকেটে গিয়েছিলেন। আর এই দুই ১৫ নভেম্বরের মাঝখানে রচিত হয়েছে শচীন রমেশ টেন্ডুলকার নামের এক বিশাল ব্যাপ্ত মহাকাব্য।

কয়েক বার খুব কাছ থেকে দেখেছি মানুষটাকে। এক সময় ইচ্ছে ছিলো, একবার একটা ছবি তুলবো। খুব ইচ্ছে ছিলো একটু কথা বলবো। ছবি তোলা বা কথা বলার সাহস হয়নি। একবার সংবাদ সম্মেলনে একটা প্রশ্ন করেছিলাম। এতো ভিড় ছিলো যে, বুঝতে পারেননি, কে প্রশ্ন করেছে। ফলে আমার দিকে না তাকিয়েই উত্তর দিয়েছিলেন।

এই যেনো হাতের নাগাল থেকে ফসকে গিয়েছিলো হীরেটা।

এক সময় এসে নিজেকে স্বান্তনা দিয়েছি, সবাই তো চাইলেই চাঁদ ছুতে পারে না। দূর থেকেই জোসনা দেখে খুশী থাকতে হয়।

শচীন টেন্ডুলকার কে?

এটা একটা মজার আলাপ। এখনই রেকর্ড বই খুলে বসুন। ব্যাটিংয়ের প্রায় সব রেকর্ডে শীর্ষে দেখতে পাবেন এই লোকটার নাম। পরিসংখ্যান কখনো কখনো সত্যি বলে না। তাই বলে আপনি পরিসংখ্যান অস্বীকার করবেন?

সে উপায় নেই। পরিসংখ্যান বলবে, ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান শচীন টেন্ডুলকার।

আর এখানেই লোকেদের আপত্তি। সবার চোখকে তো পরিসংখ্যান এসে বাধ্য করতে পারে না একইরকম মুগ্ধ হতে। তাই কারো কাছে ব্যাটিংয়ের শেষ কথা স্যার ডন ব্র্যাডম্যান। কারো কাছে আবার এই স্বীকৃতিটা কেবলই ব্রায়ান চার্লস লারার জন্য।

আচ্ছা, সে ভালোবাসার কথা না হয় তোলাই রইলো। পরিসংখ্যানের কচকচানিও টানলাম না। তাহলে শচীন টেন্ডুলকারের অবস্থান ক্রিকেট ইতিহাসের কোথায়?

আমি বলবো, শচীন হলেন খেলাধুলার ইতিহাসের অন্যতম সেরা পারফরমার। তার সাথে হয়তো ডিয়েগো ম্যারাডোনার একটা তুলনা হলেও হতে পারে। সেই চাপ, সেই একা একা পথ চলা। আর কেউ তার এই ব্যাপারে ধারেকাছেও নেই।

সেই ১৯৮৯ সালে পাকিস্তানের সাথে যখন অভিষেক হলো, তারপর থেকে একটু একটু করে তার কাঁধে চেপে বসেছিলো ভারতের কয়েক কোটি মানুষের এক জোড়া করে চোখ এবং বুক ভরা অসম্ভব প্রত্যাশা। ভারতের সেই দলটা ছিলো ক্ষয়িষ্ণু। বিশ্বকাপজয়ী দলের প্রতাপ তারা হারাতে শুরু করেছে। একে একে দলটা থেকে তারার ঝাক বিদায় নিলেন। দলটায় রইলেন কেবল একজন দৃঢ়চেতা অধিনায়ক মোহাম্মদ আজাহারউদ্দিন। আর রইলেন সব স্বপ্নপূরণের এক পরশপাথন হয়ে শচীন।

টিম গেম বলে কথা। এ কী একা একা এক প্রান্তে ব্যাট করে জেতানো যায়!

যায় না। তারপরও ভারতীয়রা চিপটে ধরলো এই ৫ ফুট ৫ ইঞ্চির লোকটাকে। তাকে সব করতে হবে। তাকে ইনিংস শুরু করে শেষ অবধি ব্যাট করতে হবে। রোজ মাঠে নেমে সেঞ্চুরি করতে হবে। এবং ভারতকে অসম্ভব সব ট্রফি এনে দিতে হবে। এইসব আবদার সহ্য করে দুই দশকেরও বেশি সময় ব্যাটটা হাতে মাথাটা সুশীতল করে লড়াই করে গেছেন।

হ্যা, ক্যারিয়ারের মাঝামাঝি এসে সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড়, ভিভিএস লক্ষ্মণের মতো সঙ্গীকে পেয়েছেন। শেষ প্রান্তে এক ঝাক প্রতিভাবান তরুনের উত্থান দেখেছেন। ধোনির নেতৃত্বে সেই বাহিনী শেষ অবধি শচীনের হাতে তুলে দিতে পেরেছিলো অধরা সেই বিশ্বকাপটা।

শেষ দিনগুলো খুব সুখের যায়নি।

২০১১ বিশ্বকাপের পর থেকেই কিছু মিডিয়া তার দিন গুনতে শুরু করে দিয়েছিলো। এমনকি ‘এন্ডুলকার’ শব্দও লেখা হয়েছে পত্রিকার পাতায়। অনেক সমালোচনা হয়েছে।

মাঠের বাইরে রুখে দাড়াতে পারেন না, সমালোচনার জবাব দিতে পারেন না, উচিত কথা বলতে পারেন না, বিতর্ক এড়ানোর জন্য বা ভাবমূর্তি রক্ষার জন্য পালিয়ে থাকেন; কতো শত নিন্দা সইতে হয়েছে! এমনকি শচীন বড় ইনিংস খেললে, দল জেতে না; এমন কথাও রটানো হয়েছে; যদিও পরিসংখ্যান শচীনের পক্ষেই কথা বলে। তারপরও সমালোচনা হয়েছে।

কখনো মুখ তুলে এসব কথার জবাব দিতে আসেননি। এমনকি একটা আত্মজীবনী লিখেছেন; সেখানেও পারতপক্ষে সব বিতর্ক থেকে দূরে থেকেছেন। শুধু নিজের কাজটাই করে গেছেন; ব্যাট দিয়ে কথা বলে গেছেন।

এই একটা জীবন এমন করে নির্বিবাদে ব্যাটিংই করে গেলেন। কে জানে, হয়তো অনেক কিছু অপেক্ষা করে আছে আরেকটা জীবনের জন্য!

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...