ফুটবলে সবচেয়ে বেশি আলোচনার কেন্দ্রে থাকে কোন পজিশনের খেলোয়াড়েরা? নি:সন্দেহে স্ট্রাইকাররা। গোলের খেলা ফুটবল। তাই গোলদাতারা বেশি আলোচনায় থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয় সবচেয়ে কম স্পটলাইট কোন পজিশনের খেলোয়াড় পায়, তাহলে?
এক নি:শ্বাসে বলে দেয়া যায় গোলরক্ষকরা। গোল ঠেকানো যে কেউই ভালোবাসে না। আবার কখনো ডিফেন্ডারদের ভুলে গোল হজম করলেও সমালোচিত হন গোলরক্ষকরা।
তবে গোলরক্ষকরাও সুযোগ পান দলকে জিতিয়ে নায়ক হওয়ার। টাইব্রেকারে গোল ঠেকাতে পারলে হয়ে যান জয়ের নায়ক। আর সেটা যদি কোনো টুর্নামেন্টের সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে ঘটে তবে সেই গোলরক্ষকের শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলার বিন্দুমাত্র অবকাশ থাকে না।
সেই কাজটি করেছেন ইতালির গোলরক্ষক জিয়ানলুইজি ডোন্নারুম্মা, জিয়ানলুইজি বুফন নন। স্পেন এবং ইংল্যান্ড দুই দলের বিপক্ষে ঠেকিয়েছেন দুইটি করে পেনাল্টি, ইতালিকে এনে দিয়েছেন ৫৩ বছর পর মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের খেতাব।
ছোটবেলাতেই প্রতিভার স্বাক্ষর রাখা ডোনারুম্মাকে মাত্র ১৪ বছর বয়সেই দলে ভেড়ায় এসি মিলান। দুই বছর একাডেমিতে কাটানোর পর সেসনার বিপক্ষে যখন তার অভিষেক ঘটে তখন তার বয়স কেবল ১৫ বছর ২৫৬ দিন। সিরি এ’র ইতিহাসের দ্বিতীয় সর্বকনিষ্ঠ ফুটবলার হিসেবে অভিষিক্ত হন তিনি।
পরের মৌসুম থেকেই এসি মিলানের প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক হন তিনি। এমনকি নির্বাচিত হন তাদের ইতিহাসের সর্বকনিষ্ঠ অধিনায়ক। টানা পাঁচ মৌসুমে তাদের গোলবার সামলেছেন দক্ষ হাতে, গেল মৌসুমেও ক্লিনশিট রেখেছিলেন ১৪ ম্যাচে।
কিন্তু, তা সত্ত্বেও তার সাথে চুক্তি বাড়াতে রাজি হয়নি এসি মিলান। শৈশবের ক্লাবের এহেন আচরণে কষ্ট পান ডোন্নারুম্মা। নতুন মৌসুমে ইতালি ছেড়ে তাই পাড়ি জমিয়েছেন সুদূর ফ্রান্সে, ফ্রি ট্রান্সফারে তাকে দলে ভিড়িয়েছে প্যারিস সেইন্ট জার্মেই।
২০১৮ সালে ইতালির ভয়াবহ ব্যর্থতার পর দল থেকে সরে দাঁড়ান কিংবদন্তি জিয়ানলুইজি বুফন। বুফন ছিলেন ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা গোলরক্ষক, ইতালির গোলবার সামলেছেন দুই যুগের বেশি সময়জুড়ে। ইতালিকে জিতিয়েছেন বিশ্বকাপ।
তাঁর রেখে যাওয়া গ্লাভসের সম্মান কতটা ধরে রাখতে পারবে ২১ বছরের তরুণ ডোনারুম্মা তা নিয়ে সন্দেহে ছিলেন অনেকে। কিন্তু মানচিনি কোচ হবার পর আস্থা রাখেন তার উপরই। এরপর ডোনারুম্মা যেসব কীর্তি গড়েছেন তাতে বুফনকেই ছায়ায় ফেলে দিয়েছেন।
ইতালির হয়ে ৩৩ ম্যাচ খেললেও এখনো কোনো ম্যাচেই হজম করেননি একাধিক গোল, জালে বল জড়াতে দেননি বিশ্বরেকর্ড ১,০৪২ মিনিট। ক্লিনশিট রেখেছেন ১৯ টি ম্যাচে। তবে এবারের ইউরোটা সবার চেয়ে আলাদা। খেলতে এসেছিলেন প্রচন্ড মানসিক চাপ নিয়ে, ফ্রি এজেন্ট হিসেবে।
তার সামনে ছিল সবাইকে দেখিয়ে দেবার চ্যালেঞ্জ। কি দারুণভাবে সেখানে সফল তিনি, গ্রুপপর্বের তিন ম্যাচে জাল রেখেছিলেন অক্ষত। তবে সেরা খেলাটা বোধহয় জমিয়ে রেখেছিলেন সেমিফাইনাল এবং ফাইনালের জন্য। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই দুই ম্যাচই গড়িয়েছিল টাইব্রেকারে, সেখানে পেনাল্টি সেভ করে ইতালির নায়ক তিনিই।
১৯৯৬ সাল থেকে ইউরোতে ম্যান অব দ্য টুর্নামেন্ট পুরষ্কার দেয়া শুরু হয়, কিন্তু কখনো কোনো গোলকিপার এই খেতাব পাবেন সেটা বোধহয় কল্পনাও করেনি কেউ। ডোন্নারুম্মা করে দেখালেন, প্রথম গোলরক্ষক হিসেবে জিতলেন ইউরোর সেরা ফুটবলারের খেতাব। এসি মিলান নিশ্চয়ই কপাল চাপড়াচ্ছে দারুণ এই ফুটবলারকে হারিয়ে।
বাঁ দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ে সাকার শট ঠেকানোর পর তার প্রতিক্রিয়াহীন অভিব্যক্তি দেখে আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিল সবাই। বেদনার রঙ নীলকে আনন্দের রঙে পরিণত করে ইউরোপের সেরা এখন ডোন্নারুম্মাই।