২০০৯ সালের ১২ জুলাই। এটা সেই দিনের ঘটনা, যার পর থেকে পল কলিংউডকে ইংরেজরা ব্রিগেডিয়ার বলে ডাকে। স্থান কার্ডিফ। অ্যাশেজ সিরিজের প্রথম টেস্টের শেষ দিন। এমনিতে ইংল্যান্ডে অ্যাশেজ সিরিজের প্রথম টেস্ট মানে কোনো ঐতিহাসিক মাঠ। ওল্ড ট্রাফোর্ড, বা লর্ডস, বা বার্মিংহাম।
কিন্তু, সেবার ইংরেজরা প্রথম টেস্ট ফেলে বসলো কার্ডিফে। যা এমনকি ইংল্যান্ডেও না। ওয়েলসে। এর পিছনে অবশ্য কিছু অকাট্য যুক্তি ছিল। প্রায় দেড় যুগ পরে সেটাই ছিল প্রথম অ্যাশেজ, যেখানে অস্ট্রেলিয়া অধিনায়কের হাতে না ছিলেন ম্যাকগ্রা, না ওয়ার্ন। ব্রেট লিও ততদিনে আর টেস্ট খেলেন না।
অস্ট্রেলিয়ার বোলিং সম্বল বলতে মিশেল জনসন, পিটার সিডল, বেন হিলফেনহাউস ও নাথান হরিজ। এঁদের মধ্যে সবচেয়ে অভিজ্ঞ জনসন, এবং এই টেস্ট শুরুর সময় তাঁর টেস্ট সংখ্যা ২১। বাকি তিনজনের মিলিত টেস্ট সংখ্যা ১৪। তা এমন বোলিং আক্রমণের বিরুদ্ধে স্ট্রাউস-ফ্লাওয়ার যুগলবন্দির বুদ্ধি মাফিক প্রথম টেস্ট ফেলা হলো কার্ডিফে। কার্ডিফে তখন পাটা উইকেট হতো। হালকা স্পিনও ধরতো ম্যাচের শেষ দেড় দিন। ইংল্যান্ডের মাটিতে সোয়ান ও পানেসার মাত্র একবারই একসাথে খেলেছিলেন, সেটা এই টেস্টে। কিন্তু তখন কে জানতো, যে ম্যাচের শেষ দিন পানেসার বল হাতে নয়, নায়ক হয়ে উঠবেন ব্যাট হাতে।
টেস্টের প্রথম ইনিংসেই ইংরেজরা মারমার কাটকাট ভঙ্গিতে তুলে ফেললো ৪৩৫। অস্ট্রেলিয়ার বোলিংকে খানিকটা নাক উঁচু ভঙ্গিতেই খেলেছিলেন ইংরেজরা। নাহলে রানের গড় ৪ এর ওপর থাকে না। আর খেলবে নাই বা কেন? একে এতো অনভিজ্ঞ বোলিং। পেস আক্রমণের কথা ছেড়েই দিচ্ছি, অস্ট্রেলিয়ার তখন ‘পোস্ট ওয়ার্ন সিনড্রোম’ চলছে।
ওয়ার্নের অবসরের পর থেকে দুই বছরে হরিজ ছয় নম্বর স্পিনার। ‘গুগাবাবা’ ছবির সেই সংলাপের মতো অবস্থা তখন অস্ট্রেলিয়া স্পিনারদের। ‘তোমার মেয়াদ কদ্দিন?’ কাজেই আরেকটু দেখে শুনে খেললে ইংরেজদের সেভিংস অ্যাকাউন্টে কিছু বাড়তি রান থাকতো, আর ম্যাচের শেষ দিন ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা হতো না। তাহলে অবশ্য এই লেখারও জন্ম হতো না। তা যাই হোক, ইংল্যান্ডের ৪৩৫ এর জবাবে অস্ট্রেলিয়া তুলে ফেললো ৬৭৪। শেষ দেড় দিন ইংল্যান্ডকে ইনিংস হার বাঁচাতেই করতে হবে ২৩৯।
শেষ দিন যখন কলিংউড ক্রিজে এলেন, তখন স্কোর ৩১ রানে ৩ উইকেট। জনসন, হিলফেনহাউসকেই তখন ম্যাকগ্রা গিলেস্পি মনে হচ্ছে। পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া তখন সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরেছে ইংল্যান্ডকে। ২০০৭ এর গণঅবসরের পর ২০০৯ এর শুরু অবধি, অস্ট্রেলিয়ার বিদেশে সিরিজ জয় বলতে এক দুর্বল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। প্রাক্তনীদের মাস সমালোচনা তখন শুরু হয়ে গেছে, যে কিসের ভালো ক্যাপ্টেন তুমি? এতদিন ভালো দল ছিল তাই জিতেছ।
তার মধ্যে আবার দেশের মাটিতেই দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে সিরিজ হার। তাই ২০০৯ সালটা পন্টিং ও তরুণ অস্ট্রেলিয়ার কাছে খুব জরুরি ছিল। দক্ষিণ আফ্রিকায় জিতে কিছুটা মানরক্ষা হয়েছে, ইংল্যান্ডে অ্যাশেজ জিততে পারলে ষোলোকলা পূর্ণ।আর সেই কার্য সম্পন্ন করার প্রথম ধাপে দাঁড়িয়ে অস্ট্রেলিয়া।
আজকের দিনে দাঁড়িয়ে মনে হয়, অ্যান্ডারসন, পানেসার ও কলিংউডের এই লড়াই বোধহয় ২০০৯ এশেজ থেকে অস্ট্রেলিয়াকে মানসিক ভাবে ছিটকে দেয়। ওই সিরিজ জিতে পন্টিং ফিরলে বোধহয়, অধিনায়ক পন্টিংয়ের মূল্যায়ন আজ অনেকটাই আলাদা হতো। রেকর্ডও।
অপরদিকে স্ট্রাউসের লড়াকু ইংল্যান্ডের ভিত্তিপ্রস্তরও বোধহয় সেদিনই স্থাপিত হয়। ইংল্যান্ডও ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফর থেকে ৫১ রানে অল-আউট হয়ে মুখ কালি করে ফিরেছে। আর অ্যাশেজের প্রথম টেস্টেই হাঁসফাঁস অবস্থা। তা ইংল্যান্ডের লড়াই শুরু হলো কলিংউডের ব্যাটিং দিয়ে। সাড়ে পাঁচ ঘন্টা ধরে ৭৪ রান করেন তিনি। একদিকে যখন পরপর উইকেট পড়ছে, কলিংউড এমন ডেড ব্যাট ডিফেন্স আরম্ভ করলেন, যে ধারাভাষ্যকাররা নামকরণই করে দিলেন ব্রিগেডিয়ার ব্লক।
প্রবীন ব্রিগেডিয়ারের ধৈর্য্য ও বোলারদের বাঁচানোর নেতাসুলভ মনোভাব নাকি সেই ইনিংসের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লুকিয়ে ছিল। শেষ রক্ষা যদিও হলো না। সেটা করলেন পানেসার ও অ্যান্ডারসন। ১১.৩ ওভার কাটালেন দুজনে। রান কত করেছিলেন সেটা বড়ো কথা নয়। পানেসারের ব্যাটিং ও ফিল্ডিং নিয়ে হাসি-মজাই হতো ততদিন অবধি।
তা পানেসার সেই ৬৯ বলের ৩৫ টি খেলে ৭ রান করে নট-আউট থেকে প্রমাণ করলেন সবচেয়ে গম্ভীর মুহূর্তে তাঁর হাস্যকর ব্যাটিং না থাকলে ইংল্যান্ড প্রথমেই পিছলাতো। শেষ অবধি ইংল্যান্ড ২-১ ফলে সিরিজ জিতে এশেজ পুনরুদ্ধার করে। কিন্তু পানেসার-অ্যান্ডারসন-কলিংউডের লড়াই না থাকলে, সেই সিরিজের শেষেও অ্যাশেজের ঠিকানা বদলাতো না।
অ্যাশেজ এখনো হয়। এই ঘটনার বারো বছর পেরিয়ে গেছে। বেন স্টোকস, মিশেল জনসন, জো রুট, স্টিভেন স্মিথ, ডেভিড ওয়ার্নার, রায়ন হ্যারিস-কত কত খেলোয়াড় অ্যাশেজ মন্তাজে নিজেদের জায়গা পাকা করে নিয়েছেন। এই লড়াইটি অদ্ভুত ভাবে থেকে গেছে ফুটনোট হিসেবে। আজ নাহয় ধুলো ঝেড়ে সেটা নিয়ে একটু মাজাঘষা হোক।