দাগই ভাল!

দুই এপ্রিল, ২০১১।

প্রথম ছবি। প্রাচ্যের জলহাওয়া ক্রিকেটজ্বরে আক্রান্ত তখন। উপমহাদেশের দক্ষিণের দুটি দেশ আজ একে অপরের প্রতিমুখে যে। ভারত মহাসাগরের প্রকান্ড জলরাশি থেকে একটা সরু রেখা বেরিয়ে এসে এই দুটি দেশকে আলাদা করে রেখেছে শুধু। কিন্তু আজ আরব সাগরের তীরে এসে ঠেকেছে দুজনই। ওয়াংখেড়েতে ৷ লক্ষ্য – বিশ্বজয়। ট্রফিতে ঠোঁট ঠেকানোর লড়াই। এত কঠিন?

কিছুক্ষণ পরের কথা। ওয়াংখেড়ের লালমাটি কাঁপছে তখন। সেই ছবি টিভির পর্দার সৌজন্যে প্রতীয়মান হচ্ছে মেলবোর্ন থেকে লর্ডসে, সারা বিশ্বে। ভারতের হাত থেকে ধীর অথচ অস্থিরভাবে বেরিয়ে যাচ্ছে লড়াইটা। লঙ্কাদাপট যেন কামড়ে ধরেছে ভারতীয় ব্যাটিং কে। সেহবাগ আউট! সচীন নেই ক্রিজে। বদলে একটা ক্লিন শেভড মুখওয়ালা গম্ভীর আর তরুণ কোহলি ব্যাটদুটো দিয়ে হাল টেনে চলেছেন মালিঙ্গা-মুরালিদের সামনে।

গোটা ভারত যেন নিস্তব্ধ। টিভির সামনে চোখগুলোতে তখন শঙ্কা আর উদ্বেগের ভিড়। তবু বাইশ গজ প্রবহমান, প্রবহমান ভারতবাসীর হৃদস্পন্দনও। এমন সময়ে ধুসর কার্পেটের ওপরে সাদা লাইনের মাঝ বরাবর ব্যাটের আঁচড় কেটে যাওয়া একটা ডাইভ যেন স্তব্ধ করল সেই হৃদস্পন্দনটাকে। গৌতম গম্ভীর।

ঘামের স্পর্শে লালমাটিগুলো কাদা হয়ে যাওয়া, নীল জার্সীতে আটকে যাওয়া! উফ! সে কি দৃশ্য! উঠে দাঁড়ালেন গম্ভীর, দীর্ঘ নিশ্বাসের আওয়াজ ভেসে এল ওয়াংখেড়ে থেকে। নিঝুম গ্যালারিটা বুঝল এ লড়াই এখনই থামছে না। ভারত বুঝল এ লড়াই লঙ্কাবাহিনীর পিঠে আস্তে আস্তে করে ছুরি ফুটিয়ে চলেছে সাইলেন্ট কিলারের মত।

ইতিহাস বোধহয় বারবার ফিরে আসে! সেই ডাইভ, সেই ঘামকাদা মাখানো নীল জার্সি, সেই উঠে দাঁড়ানো, ব্যাট উঁচিয়ে ধরা, সেই অদম্য লড়াই!

৮ বছর ৩ মাস ১৩ দিন পর। ১৪ জুলাই, ২০১৯।

দ্বিতীয় ছবি। বিশ্বকাপ পায়চারি দিচ্ছে লর্ডসের ব্যালকনিতে। রানীর দেশে বিশ্বকাপ বলে কথা! গলি থেকে রাজপথ, কুঁড়ে ঘর থেকে অট্টালিকা সক্কলে সেই ক্রিকেটোৎসবের অংশীদার। দুই ফাইনালিস্টের কারোর কপালেই ট্রফিস্বাদ চেখে দেখার মাহেন্দ্রক্ষণ আসেনি এতদিন। লড়াই টা তো বেশ শক্তই!

কিছুক্ষণ পরের কথা। ব্রিটিশ ঔদ্ধত্যে আঁচড় বসিয়ে কিউইরা ধীরে ধীরে ম্যাচের রাশটাকে টেনে নিচ্ছে নিজেদের দিকে। কেন্ উইলিয়ামসনের সুক্ষ্ম গেমপ্ল্যানের দৌলতে ব্ল্যাকক্যাপ্স সদস্যরা তখন বাইশ গজ দখল নিতে শুরু করেছে সবে, রানীর দেশের ভরসা এখন আরেক কিউই। বাটলার আর স্টোকসের ক্রিজে পড়ে থাকার দরুণ এখন দুই দলই জয় আর পরাজয়ের মাঝখানের দন্ডটিতে ভর করে দাঁড়িয়ে।

পর্দা থেকে চোখ সরেনি কারোর। দেখতে দেখতে ওয়াইড লং-অন থেকে ছুটে আসা একটা থ্রো, আর একটা সাংঘাতিক ডাইভ। কারোর মাথায় হাত! কেউ কেউ মুখটা পেঁচিয়ে ঊহ! আবার কারোর গলা ফেটে বেরিয়ে আসছে ধুস জাতীয় কোনো শব্দবন্ধ! বেন স্টোকস। আদতে যার সেদিন কালো জার্সী পরে এই ডাইভ দেওয়ার কথা।

আরে কিউই বংশোদ্ভূত তো! উঠে দাঁড়ালেন স্টোকস, আবারো সেই ঘামকাদা মাখা জার্সী, একদলা কাদা বুকের মাঝ বরাবর ছিটিয়ে গেছে। যেন দুনিয়ার সামনে ছুঁড়ে দেওয়া একটা অশনিসংকেত, যেন দুই এপ্রিলের রাত মনে করানোর ছোট্ট একটা মুহূর্ত।

ওয়াঙখেড়ে থেকে লর্ডস। কত পথ, কত দুরত্ব। ভারত আর ইংল্যান্ড। কত ঐতিহ্যের অমিল দুই দেশের মাঝে, কত সংস্কৃতির বৈষম্য দুই দেশের। সর্বোপরি গম্ভীর আর স্টোকস। কোনোদিন একসাথে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন কিনা জানা নেই, দুজনের ক্রিকেটীয় দক্ষতার মিলও নেই খুব একটা। কিন্তু এই একটা সেকেন্ড, একটা ক্ষণিকের ডাইভ এক করে দিয়েছে দুই ভিন্ন চরিত্রকে।

তেরঙা বুকে জড়িয়ে নিয়ে অতন্দ্র প্রহরীর মতো ওয়াংখেড়ের কালো আকাশের নীচে সেদিনের লড়াই আর তার সাড়ে আট বছর পরে লর্ডসের গালিচায় দুরন্ত ডাইভ — কত মিল, কত এক। এ ডাইভ সবাই দিতে পারেনা, দিলেও জার্সীতে কাঁদা লাগিয়ে যেতে পারেনা, কর্দমাক্ত হলেও বিশ্বকাপ ছুঁয়ে যেতে পারেনা। তাই তো এ ডাইভ অদ্বিতীয়, এ লড়াই দুর্দম্য!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link