রাঁচির ধোনির মোহিনী বাঁশি

২০০৫ এর দুপুর। এক টাকার কাঠি আইসক্রিম, পঁচিশ পয়সার ল্যাবেঞ্চুস। সাদাকালো স্যালোরায় আফ্রিদিকে এগিয়ে এগিয়ে মারছে রাঁচির মহেন্দ্র সিং ধোনি। রানা নাভিদের টাকমাথায় একটু বেশিই ঘাম। সৌরভ গাঙ্গুলি খুশ। জন রাইট খুশ।

ইনজামাম চিন্তার ভাঁজে কোঁকড়ানো। অস্তিত্ব সংকটে গ্যালারির অতিপরিচিত ‘বুম বুম আফ্রিদি’ পোস্টার। ক্যামেলের দশ টাকার প্যাস্টেল কালার সেটে আমার পায়োনিয়ারের আঁকার খাতায় ছবি হয়ে ফুটে রইল রাঁচির ধোনি। ছেলেমানুষী ঢঙে মোমরঙ দিয়েই ছবির নীচে লিখে দিলাম-বুম বুম মাহি।

২০০৫ এর শীত। আমার কালীপুজোর দুপুর। বুড়িমার ফুলঝুরি, দশ টাকার কালীপটকা, সিকি আনার ছুঁচোবম। মামাবাড়ির রংচঙে এল জিতে চামিন্দা ভাস ছিন্নভিন্ন, অসহায় গোঙানী ফার্নান্ডো, মাহরুফ, এমনকি মুরালিরও। সাঙ্গাকারার সেঞ্চুরি ম্লান।

ন্যাশানাল টিভির ফোর্থ আম্পায়ারে উল্লাস, অমরনাথের মুখে চওড়া হাসি। রাঁচির ধোনি, আমি তোমাকে ভালোবাসি। সন্ধ্যেবেলায় ঝিকমিকে ফুলঝুরি, ছোট্ট আমির ছোট্ট চিৎকার—ভিডিওকন কাপে ভারত মারলো তুড়ি।

২০০৬ এ শীত ফিরে এলো। বাইরে ধানকাটার মৌসুম। দানিশ কানেরিয়াকে এগিয়ে মেরে রাঁচির ধোনি বুম বুম। আসিফের সিম, সালমানের স্কোয়ার কাট। আমার ভীত মনে তবুও রাঁচির ধোনি অনেক স্মার্ট। রানা নাভিদকে উত্তম প্রহার, বাইরে আছড়ালো সামি-আরাফাতের বল। রবি শাস্ত্রী রায় দিয়েছেন, রাঁচির ধোনি সেনসেশনাল।

২০০৭ এর টিউশন। পাঁচ টাকার ট্রাম্পকার্ডের দাম একটু বেড়েছে। বাজারে উঠছে এমপি থ্রি, এমপি ফোর নামের নতুন নতুন শব্দ। জন আব্রাহামের বাইক-সোয়াগে ঢলে পড়ছে উঠতি টিনেজার। রাঁচির ধোনি চুল কেটেছে। এখন আর অতোটা এগোয়না।

এখন আর ছয়গুলো আছড়ে পড়েনা। এখন কিন্তু ছোটো চুলের বিয়ার্ডেড ধোনি অনেক স্মার্টার। ক্যালকুলেশন করছে, ফিল্ড প্লেস করছে, ম্যাচকে ডিপে নিয়ে গিয়ে শেষ করে আসছে। তবে স্লগ ওভারে চেনা সুর। পুরোনো হাতে পড়ে পুরোনো ভায়োলিনের রাগ বড্ডো সুমধুর। শেষ দশ ওভারে বাদক ধোনির ব্যাটে আছড়ে পড়ে আকাশউঁচু ছক্কানামার চেনা রাগ ,চেনা লয়।

২০০৮ এর ইউনিট টেস্ট। ইউজ অ্যান্ড থ্রো পেনের দাম দু’টাকা। ভূগোল পরীক্ষায় উত্তর গোলার্ধ আঁকতে আঁকতে মন চলে যাচ্ছে দক্ষিণ গোলার্ধের দেশে শচীনের কারবারিতে। বিকালের বৃষ্টি শোনাচ্ছে সুমনের ‘পুরোনো গান’। ভাজ্জির দুসরায় ঘুরে যাচ্ছে ভারতের রেখা।

অনিলের বাঁকানো কব্জি। গম্ভীরের কাট। ব্র‍্যাকেন-ম্যাকগ্রা-লি-সাইমন্ডসকে কাঁদিয়ে ধোনিও বেধরক ঘোড়াচ্ছে ব্যাট। ক্লার্কের মুখ একটু চোপসা, শমিত পন্টিংয়ের মুখে একটু ভয়। পাল্টে যাওয়া ধোনি-কুম্বলের ভারত দেখিয়ে এসেছে অস্ট্রেলিয়া আর অপরাজেয় নয়।

২০০৯-১০ বড্ডো আগ্রাসী। মাইক হাসির সাথে পাল্লা দিচ্ছে রাঁচির ধোনির মোহিনী বাঁশি। ধোনির মার এখন গ্রাউন্ডে বেশি, আকাশে কম। জনসনের সাথে ধাক্কাধাক্কি, সোহেল তানভীরের অহেতুক আগ্রাসন। ধোনি সামলালেন সবকিছুই। অটল শীর্ষ ব্যাটসম্যানের আসন।

১১ সালে বিশ্বকাপ। ভারত তাতছে গায়ক শঙ্করের গানে। পেপসির অ্যাডে স্লিঙ্গা, আপার-কাট, উল্টাপাল্টার চেয়েও হেলিকপ্টারের দাম বেশি। রাঁচির ধোনির অফ ফর্ম। আউট করছে শন টেট। আউট করছে ওয়াহাব। দোসরা এপ্রিলের রাত্রে মুরলির দুসরা তবুও কুপোকাত।

কলারটা উঁচিয়ে রিবক হাতে নামলেন। ক্রাউড প্রেসার, ব্যাকপেইনে মাসলটাও টাইট। ওয়াংখেড়ের রাত দেখলো, বিগ প্লেয়ারস প্লে অ্যাট বিগ নাইট।

২০১২ এর চেন্নাই। ভারত ভাঙছে জুনাইদ খানের সিমে, মোহাম্মদ ইরফানের বাউন্সে। রাঁচির ধোনির বয়স বাড়ছে। ফুটওয়ার্কটা গণ্ডগোলে। ২৯/৫ থেকে ২২৭। ধোনি জানালো আমিই তোমার চেনা রক্ষক, চেনা বট; সোনালী,কালো কিংবা পাক ধরা চুলে।

ধোনির ব্যাটে রান নেই। হ্যান্ড-আইটা থুড়থুড়ে। ২০১৭-এর কটক দেখলো, পুরোনো চাল বেশ ভাতে বাড়ে। পিচের ওপারে পুরোনো সাথী, মাঠের ওপারে পুরোনো আওয়াজ। ২৫/৩ থেকে ৩৮১। অরণ্যদেব রাঁচির ধোনি, নীললোহিতটা যুবরাজ।

২০১৯ এর শীতের বিকেল। ছোট্ট আমি ডাক্তার এখন। পায়োনিয়ারের আঁকার খাতা বদলেছে ক্লাসমেটের নোটপ্যাডে। কাঠি আইসক্রিমটা হারিয়ে গেছে। সিকি পয়সাও উধাও। সবাই গেছে অবসরে — রানা নাভিদ থেকে শোয়েব আখতার,ভাস থেকে মুরালি, পোলক থেকে এনটিনি।

মেলবোর্নের আগন্তুক দর্শক তবু লিখছে, ‘নেভার রিটায়ার ধোনি’। অস্ট্রেলিয়ার সন্ধ্যে। আকাশটা ঘন কালো। ধোনির চুল সাদা। চওড়া থাই, চওড়া কাঁধ, ঠিক যেনো শঙ্খ ঘোষের ‘পুরোনো বট’। জবুথবু অ্যারন ফিঞ্চ, জবুথবু বর্ডারের জার্সি পরা সবুজ-হলুদ অজি। রিচার্ডসন, স্টোয়িনিস, সিডলরা জ্ঞানশূন্য হিতাহিত। আটত্রিশ বছরের ধোনি জানালো,আজ আমিই অরণ্যদেব, আমিই নীললোহিত।

১৯-এর বিশ্বকাপটা বড্ডো ট্র‍্যাজিক। ইংল্যান্ড ম্যাচে আঙুল ফাটলো। নিউজিল্যান্ডে ম্যাচে বুক ফাটলো। বিদায় ভারত। ধোনির ভারত। চলছে কাটাছেঁড়া, চলছে তরজা। ভারতের ভীষ্ম নিলেন স্বেচ্ছামৃত্যু। বাণের চাদরে পড়ে রইল তার শরশয্যা।

আফ্রিদি-কানেরিয়া থেকে নাথান লিও-বেন স্টোকস। সিঁকি পয়সার ল্যাবেঞ্চুস থেকে একশো টাকার ডেইরি মিল্ক। কাঠি আইসক্রিম থেকে কর্নেটো। মোশারফ থেকে ইমরান খান। রবি শাস্ত্রীর ‘সেনসেশানাল ধোনি’ থেকে আকাশ চোপড়ার ‘মাহি মার রাহা হ্যায়। বদলাচ্ছে সময়, বদলাচ্ছে আঙ্গিক।

রাঁচির ধোনি, ভারতের ধোনি, বিশ্বের ধোনি তবু প্রাসঙ্গিক। পুরানো বটের চওড়া থাই, নীললোহিতের সময়বিজয়ী প্রাকার, অরণ্যদেবের ট্যাটুহীন বলিষ্ঠ বাহু। মহেন্দ্র ধোনি কি আজও গাইবেন,ম্যায় ‘স্রেফ’ পাল দো পাল কা শায়ের হু?

হে মুহূর্তবিজয়ী, হে অসংখ্য ধ্বসের চিরবট,তোমাকে জানাই  নীললোহিতের উপন্যাস, শঙ্খ ঘোষের কবিতা — ‘পুরোনো গাছের গুঁড়ি, বাকলে ধরেছো কত ঘুণ।’

আমার এঁকে যাওয়া এ ছবি, একা আমার কুক্ষিগত নয়। এ ছবি সবার, এ ছবি আমাদের, আমজনতার অনগণ্য বিশ্বায়নের। মৃণাল সেনের ‘ইন্টারভিউ’টা আজ খুব মনে পড়ছে —‘একে আপনারা ছবি বলেন? এতো আমার গল্প, আপনার গল্প।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link