পরপর দুই বলে দলের দুই কাণ্ডারির বিদায়। একজন ভিতটা শক্ত করে জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ার আগেই কিপারের হাতে ধরা পড়লেন। শটটা আত্মঘাতী বললে দোষ হবেনা। পরের জন বিপদের বন্ধু হিসেবে পরিচিত হলেও, এবার কিছু বুঝে উঠার আগেই সাজঘরের পথে তিনিও। উদ্ধার করতে এসে নিজেই পতিত বিপদে।
স্কোরকার্ডে তখন ৪ উইকেট হারিয়ে ২০৪ রান। জয় থেকে দূরত্ব ৯৪ রানের। বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে মেঘ উঁকি দিচ্ছিলো। আর জিম্বাবুয়ে কিছুটা আশা খুঁজে পায় ধবলধোলাই এড়ানোর। অপরপ্রান্তে মিঠুন তখনও মাঠে থিতু হননি। অফ-ফর্মের গেঁড়াকলে বন্দী মিঠুনের মাঠের চেয়েও মনের থিতু হওয়া ঢের বেশি যুদ্ধের ছিলো।
ততক্ষণে ৩০ বল মোকাবেলা করে অর্ধেক রান তার ব্যাটে। হ্যাট্রিক বল সামলাতে এসে বেশ নির্ভার পরিচয় দিলেন নুরুল হাসান সোহান। সুইপারে ব্যাট চালিয়ে দৃষ্টিনন্দন চার। তাতেই খুললো ব্যক্তিগত রানের খাতা। চাপের মূহুর্তেও এমন নির্ভার শট খেলার জন্য কৃতিত্ব তো তাকে দিতে হবে।
সোহান নাতো নতুন জাতীয় দলে, নাতো ক্রিকেটে। উভয়দিকেই সোহান বেশ পরিচিত ও প্রবীণ একজন। তাই শুরুতেই শান্ত মস্তিষ্কের প্রমাণ মিললো। জাতীয় দলে ৬ বছর আগে অভিষিক্ত কেউ নিঃসন্দেহে প্রবীণের খাতায় পড়েন। আবার, ওতটাও প্রবীণ নন যে বাতিলের খাতায় পড়ে যাবেন। ঠিক ততোটাই প্রবীণ! যতোটা প্রবীণ হলে জাতীয় দলের দরজায় ৬ বছর পরেও ঠকঠক কড়া নাড়া যায়।
সোহান কড়া নাড়তে নাড়তে ক্লান্ত বা ক্ষান্ত কোনোটাই হননি। কখনও তার মনে হয়নি যে, ‘আমি ভুল দরজায় কড়া নেড়ে যাচ্ছি।’ বরঞ্চ দরজার ভেতর থেকে বারবার — এটাই সঠিক দরজা বলে উত্তর এসেছে। তাই হাল না ছাড়ার মানসিকতায় সোহান দরজার বাইরে অপেক্ষা করেই গেছে। শেষ কয়েক বছরে দুয়েকবার ভেতরে প্রবেশ করতে পারলেও সুযোগ হয়নি সময় নিয়ে স্থায়ীভাবে অবস্থান করার।
এবারও সুযোগ হলো, তাও বহু কাঠখড় পোড়ানোর পরেই। এ চিত্র কেবল সোহানের বেলায় নয়! জাতীয় দলের অপেক্ষায় থাকা বাকিদের ক্ষেত্রেও। কিন্তু, এবার নির্দ্বিধায় বলা চলে সোহান স্থায়ী বাসিন্দা না হয়ে হাল ছাড়ছেন না। এ যাত্রায় স্থায়ী হওয়ার আকুলতা তার মাঝে তীব্র।
ব্যাটিং অর্ডারে আজ সোহানের আগে ছিলেন মোসাদ্দেক। আবার এই মোসাদ্দেক ছিলেন রিয়াদের আগে। অথচ, মোসাদ্দেক বাদে ব্যাট করতে পেরেছেন বাকি দু’জন। একজন সম্পূর্ণ ব্যর্থ, আরেকজন তাই অন্যের ব্যর্থতার চিত্র ঢেকে দেওয়ার তাগিদে খেললেন অনবদ্য এক ইনিংস।
মোসাদ্দেকের চেয়েও জাতীয় দলে ৩৮ ম্যাচ কম মাঠে নেমেও আস্থার পূর্ণ প্রতিদান দিলেন। যে ৬টি চার হাঁকিয়েছেন, সবগুলোতেই ছিলো মুগ্ধতার ছোঁয়া। আস্থার প্রতিদান দেওয়ার তীব্র বাসনা। বহুদিন ধরে দরজায় কড়া নাড়ার পরেও সুযোগ না মেলার ক্ষণিকের প্রতিবাদ। ৬টি চারের শটগুলো লক্ষ্য করলে দেখবেন — সোহান মোটেও তাড়াহুড়ো করেননি। জয় নিয়ে ম্যাচ শেষ করার দায়িত্ব নিয়ে নেমেছিলেন তা ছিলো স্পষ্ট।
সুইপার, লং অফ, লং অন, স্কয়ার লেগ, মিড উইকেটের চার গুলোর জন্য খেলা প্রতিটা শট ছিলো নিখুঁত ও নিয়ন্ত্রিত। ছিলোনা কোনো বাড়তি ঝুঁকি নেওয়ার তাড়া। এবং মস্তিষ্কে আতঙ্কের বিন্দুমাত্র চিহ্ন ছিলো বলেও মনে হয়নি। তবে, প্রতিপক্ষকে আতঙ্কে ফেলেছেন। দীর্ঘদিনের ক্রিকেট অভিজ্ঞতাকে পুরোদমে ব্যবহার করলেন ৩৯ বলের ৪৫ রানের ইনিংসে। সোহানের এই রান বার্তা দিচ্ছে, ‘দ্রুতগতির ক্রিকেটে দ্রুত রান তোলার ক্ষমতার।’ বর্তমান বাংলাদেশ দলটায় এমন ব্যাটসম্যানের বড্ড অভাব।
মনে করিয়ে দিলেন, ডিপিএলে প্রাইম ব্যাংকের বিপক্ষে নিজের ১৭ বলে ৪৪ রানের ম্যাচ জয়ী ইনিংসটাকে। সেদিন রুবেল, মুস্তাফিজ ও শরিফুল কেউই তার শাসন থেকে রেহাই পাননি। চিরচেনা মিরপুরে তাণ্ডবলীলা চালিয়ে শির উঁচু করেই জয় নিয়েই ছেড়েছিলেন মাঠ। বার্তা দিয়েছিলেন সাদা বলের যেকোনো ফরম্যাটে যোগ্য দাবিদার তিনি। সে বার্তা কিনা পৌঁছেও গেলো ঠিক দরবারে। তাই জিম্বাবুয়ে সফরে দ্বার উন্মোচিত হয়ে দলের সাথে।
প্রথম দুই ম্যাচে একাদশে সুযোগ পাওয়ার আশা থাকলেও মিলেনি। সাইড বেঞ্চে থাকতে হয়েছে। একদিন অবশ্য কিপিং করেছেন লিটনের ইঞ্জুরিতে আর আইসিসির নতুন নিয়মের সুবাদে। আজ মিরাজের জায়গায় একাদশে ঢুকলেন। মিরাজের জায়গায় কখনও সোহান নয়! তবে সোহানের তাতে মোটেও ভ্রুক্ষেপ ছিলোনা। ছিলো কেবল প্রমাণ করার তাড়না। তাতে সফলও বটে। সুযোগকে এভাবেই কার্যকর করে নিতে হয়।
দেশের ক্রিকেটে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে বিচক্ষণ উইকেট কিপার হিসেবে সোহানের জুড়ি নেই। আবার, একইসাথে ব্যাটসম্যান হিসেবেও জেগে উঠেছেন। সোহানের ব্যাটিংয়ের স্থান লাভের প্রতিযোগিতা তৈরি হয়ে গেলো আজ থেকে মিঠুনের সাথে। মুশফিক সাদা বলের কিপিংকেও বিদায় না জানানো পর্যন্ত সোহান দলে সুযোগ পেলেও গ্লাভস ছাড়াই মাঠের অন্যকোনো প্রান্তে দেখা মিলবে তার।
অন্যসব উইকেট কিপারের মত সোহানও এমএস ধোনী ফ্যান। তার কিপিং ও ব্যাটিং উভয়দিকেই ছিলো তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। ২০১৭ চ্যাম্পিয়ন’স ট্রফিতে সাক্ষাতও করেছিলেন। ধোনীর উপদেশ কতটুকু কাজে লাগাতে পেরেছেন বা পারবেন! তা নিয়ে কিছু বলার সময় না আসলেও, নীতিবাচক বার্তাই আজ দিলেন ফিনিশিংয়ে ভূমিকা রেখে। ঠান্ডা মাথার নেতা ধোনী হতে অনুপ্রাণিত দলের আরেক ঠাণ্ডা মাথার খুনী মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ।
দু’জনই আবার সোহানের প্রিয়। রিয়াদের অধিনায়কত্বে শুরু তার পেশাদার ক্রিকেট। একই ব্যক্তির কাছ থেকেই অভিষেকে ওডিআই ও টি-টোয়েন্টি ক্যাপ নিয়েছেন। প্রতিবেশি দেশের ঠান্ডা মাথার নেতা ও দেশের ঠান্ডা মাথার খুনী থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সোহানও বনে যাক দলের কাণ্ডারি।