প্রেরণা দিয়েছে, শক্তি দিয়েছে

আলফিও বাসিল; নামটা কি কোনো আর্জেন্টাইন সমর্থক ঠাওর করতে পারেন? পার আর্জেন্টিনা ভক্ত না হলে এই নামটা মনে রাখার কোনো প্রশ্নই আসে না। আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে চড়ানোর সৌভাগ্য হয়েছিল তার মাত্র ৮ ম্যাচে। সেন্টার ব্যাক থেকেও করেছিলেন এক গোল। তবে তাকে মনে রাখা সে কারণে নয়।

তাঁকে মনে রাখার কারণ আর্জেন্টিনার ডাগ-আউটে দাঁড়িয়ে করা শেষ গর্জনের জন্য। তার হাত ধরেই শেষবারের মতন শিরোপা উঁচিয়ে ধরেছিল আর্জেন্টিনা। আনন্দে মেতেছিল আর্জেন্টিনাবাসী।

১৯৯৩ সালের ৪ জুলাই গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতার ২ গোল শেষবারের মতন শিরোপা এনে দিয়েছিল আর্জেন্টিনার কোলে। এরপর তিন দশকের কাছাকাছি সময় পেরিয়ে গিয়েছে, কেউ কথা রাখতে পারেনি। কেউ শিরোপা এনে দিতে পারেনি এই দলটার কাছে। ডাগ-আউটে কম বড় নাম আসেনি। কিন্তু নামের সুনাম কেউই করতে পারেননি। একমাত্র কোচ হিসেবে তিনিই সামলেছেন ম্যারাডোনা আর মেসিকে!

মার্সেলো বিয়েলসা, হোসে পেকারম্যান, ডিয়েগো ম্যারাডোনা, আলেহান্দ্রো সাবেলা, হোর্হে সাম্পাওলি – সর্বজয়ী কোচেরা এসেছেন, ডাগ-আউটে বসেছেন কিন্তু কোচের কোটটা গায়ে চাপাতেই কেমন যেন হারিয়ে গিয়েছেন, শিরোপার ছোঁয়া আর দিতে পারেননি। এমনকি আলফিও বাসিলকেও আর্জেন্টিনা নিয়ে এসেছিল, নিজেদের এতদিনের দূর্দশা কাটাতে, লাভ হয়নি। ০৭ কোপা আমেরিকা হেরে গিয়েছেন ব্রাজিলের কাছে এসে।

কোনো কিছুতেই যেন সমাধান মিলছিল না আর্জেন্টিনার। ২০১৮ বিশ্বকাপে কোচ হিসেবে ছিল হোর্গে সাম্পাওলি। নক-আউট রাউন্ডেই ফ্রান্সের কাছে হেরে বাদ হয়ে যাওয়ার পর তার বরখাস্ত হওয়া ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। চিলিকে কোপা জেতানো কোচ দ্বিতীয় পর্বই পার করতে পারলেন না আর্জেন্টিনাকে নিয়ে।

বোর্ডের মাথায় তখন নতুন কাকে আনা যায়, তা নিয়ে চিন্তা। বড় বড় নামের পেছনে ছুটে গত ২৫ বছরে কোনো লাভই হয়নি। বরং একের পর এক স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে তাদের অধীনেই। এবার কোনো নতুন নামের পেছনে ছোট যাক। এএফএ-এর প্রেসিডেন্ট ক্লদিও তাপিয়া তাই সাম্পাওলিকে যেতে দিলেও যেতে দিলেন না তার সহকারীকে।

গত দুই বছর ধরে সামাপাওলির কাছ থেকে কাজ শিখছেন ৪০ বছর বয়সী স্কালোনি। তার উপরেই দায়িত্ব বর্তানো যাক। যদি না হয় তবে নতুন কারো পেছনে ছোটা যাবে। সে ভাবনা থেকেই হুট করে আর্জেন্টিনা দলের দায়িত্ব এসে পড়ল স্কালোনির উপর। আর সেই সাথে মাথার উপর সর্বক্ষণের চাপ, যেকোনো দিন খড়্গ চলতে পারে তার উপর, ডাগ-আউটে চলে আসতে পারে সিমিওনের মতন বড় কোনো নাম!

তাকে দায়িত্ব দেওয়ার আরেকটা বড় কারণও ছিল। মোটামুটি ভঙ্গুর আর্জেন্টিনা বোর্ডের পক্ষে আর বড় নাম চালানো সম্ভব ছিল না। পকেটের টান থেকে বাঁচতেই বাধ্য হয়ে ছোয় নামের পেছনে দৌড়েছিলেন তাপিয়া। সে কারণেই হুট করেই স্কালোনির মাথায় চাপে আর্জেন্টিনার কোচ হওয়ার গুরু দায়িত্ব!

শুধু কোচ হিসেবে ডাগ-আউটে বসলেই তো হবে না, তার পুরো টিমকে তো ঠিক করতে হবে। তার এই টিমের সদস্য হলেন মোট চারজন। তিনি নিজে, পাবলো আইমার, ওয়াল্টার সামুয়েল আর রবার্তো আয়ালা। চারজনে মিলে শুরু করলেন আর্জেন্টিনা দলকে নতুন করে প্রাণ দেওয়ার কাজ।

কাজটা মোটেও সহজ ছিল না। স্কালোনি আর্জেন্টিনাকে খুব ভালোমতো চিনেন বললে ভুলই হবে, সর্বসাকল্যে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ৭ টি। যদিও ক্যারিয়ার গড়েছেন স্পেনে, কিন্তু জাতীয় দলে বড় খেলোয়াড় হওয়ার স্বপ্নটা স্বপ্নই রয়ে গিয়েছে তার। পাবলো আইমার ছিলেন লিওনেল মেসির আইডল। কিন্তু তারও অবস্থান অনেকটা স্কালোনির মতন, ক্লাবেই সাফল্য পেয়েছেন, জাতীয় দলে ততটা নয়।

তবে রবার্তো আয়ালা আর ওয়াল্টার সামুয়েল ছিলেন আর্জেন্টিনার নিয়মিত মুখ। যতদিন খেলেছেন, ততদিনই নিজের নামের সুনাম করেছেন। ওয়াল্টার সামুয়েলের নামের পাশে তো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে একটা ট্রেবলও! তাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা অদ্ভুত মিলও রয়েছে, প্রত্যেকেই লিওনেল মেসির সতীর্থ আর প্রতিপক্ষ হয়ে খেলেছেন অনেকটা সময়! আর সেই লিওনেল মেসিই হয়েছিল তাদের কোচিং জীবনের প্রথম বাঁধা!

আর্জেন্টিনা দলে মেসির অভিষেকের পর থেকে একটা কথা অমোঘ সত্য, লিওনেল মেসিকে কেন্দ্র করেই বারবার দল গঠন করা হয়েছে। ম্যারাডোনা থেকে সাম্পাওলি, সবাই একই পথ ধরেছিলেন। মাঝখানে সাবেহা একটু ভিন্ন পথ চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু ধোপে টেকেনি।

স্ক্যালোনি গংয়ের মূল বাঁধা ছিল দলের মধ্যেথেকে এই মেসি নির্ভরতা বের করে আনা। চারজনের তিনজনই ছিলেন খেলোয়াড়ি জীবনে ডিফেন্ডার, ফলে তাদের খেলাটাও ছিল ডিফেন্সিভ। স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসনের বিখ্যাত পরামর্শ, ‘অ্যাটাক ম্যাচ জেতায় এবং ডিফেন্স জেতায় শিরোপা’ মেনেই মাঠে নেমেছিলেন তারা।

তাদের জন্য শাপেবর হয়ে এলো লিওনেল মেসির ছুটি নেওয়া। বিশ্বকাপের পর পর জাতীয় দল থেকে কয়েকমাসের ছুটি নেন মেসি। আর তখনই মেসিনির্ভর দল থেকে একটা সুন্দর দল বানানোর জন্য উঠেপরে লাগেন স্কালোনি। তার মূল লক্ষ্য ছিল দলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা, যাতে মেসি না থাকলেও এই দলের খেলতে বিন্দুমাত্র সমস্যা না হয়। ওল্ডগার্ডদের বাদ দিয়ে তরুণ দল গড়ায় মনোযোগ দিয়েছিলেন স্কালোনি। আর সেটাই হয়ে উঠেছে তার বড় অস্ত্র।

ম্যাচ জিততে হয়ে গোল লাগে বটে, কিন্তু ম্যাচ বাঁচাতে সবচেয়ে বেশি দরকার ডিফেন্স। স্কালোনি সে জায়গাতেই মনোযোগ দিয়েছেন। আর্জেন্টাইন লিগের উপর আর নির্ভরশিল না থেকে বাইরের লিগের সেরা খেলোয়াড়দের উপর নজর দিয়েছেন, ডেকে এনেছেন। সুযোগ পেয়েছে ডি পল, নিকো গঞ্জালেজ, লো সেলসোর মতন খেলোয়াড়। দলে ডাক পেয়েছেন এমি মার্টিনেজ, পাপু গোমেজ, ক্রিশ্চিয়ান রোমেরোর মতন খেলোয়াড়।

যে নামগুলোকে এতকাল কোনো কোচ ভুলেও ডেকে দেখতো না, তারাই হয়েছেন স্কালোনির মূল অস্ত্র। যদিও দিনশেষে রক্ষা করতে মেসি-ডি মারিয়াই এসেছেন, কিন্তু তাদের ছাড়া যে অচল আর্জেন্টিনা, সেটা একবারের জন্যও বুঝতে দেননি স্কালোনি।

আর সেটাই বারবার প্রমাণ হয়েছে মাঠে। নামে বড় নয়, বরং খেলায় বড় হয়ে স্কালোনি আর তার কোচিং টিম দেখিয়েছেন কীভাবে শিরোপা নিজেদের করে নিতে হয়। ২৮ বছরের শিরোপাক্ষরা স্কালোনি ঘুচিয়েছেন নিজের ডিফেন্সিভ ট্যাক্টিস দিয়ে।

অনেকে প্রথমে সমালোচনা করেছিলেন, আর্জেটিনার সাথে নাকি এই ধরনের খেলাটা ঠিক যায় না। কিন্তু দিনশেষে স্কালোনিই জিতিয়েছেন, স্বপ্নপূরণ করেছেন আর্জেন্টিনাবাসীর। নিজের বিরক্তিকর ডিফেন্সিভ ফুটবল দিয়ে।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link