তখন ইউরো চলে। ইংল্যান্ডের হয়ে শেষ পেনাল্টি নিতে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বুকায়ো সাকা। এমনিতেই বয়সটা মাত্র ১৯, তার উপর দেশকে রক্ষা করার শেষ পেনাল্টি। বিশাল চাপ নিয়ে পেনাল্টি স্পটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন আর্সেনাল তারকা।
হঠাৎই তাঁর দিকে চিৎকার করে উঠলেন ইতালির অধিনায়ক জর্জিও কিয়েলিনি। মুখে প্রশান্তির হাসি, শিরোপা যেন এখানেই নিশ্চিত হয়ে গিয়েছে ইতালির। মিনিট খানেকের মধ্যে সেটাই হলো, ডান দিকে নেওয়া জোড়ালো শট আরামসে থামিয়ে দিলেন জিয়ানলুইজি ডোনারোম্মা। আনন্দে মেতে উঠল ইতালি, রোমে ৫৩ বছর পর ফিরলো ইউরোর শিরোপা!
প্রেস কনফারেন্সের শুরুতেই ছিল এই প্রশ্নটা। কী এমন বলে উঠেছিলেন কিয়েলিনি যে বলার সাথে সাথেই মুখের হাসিটা চওড়া হয়ে গিয়েছিল কিয়েলিনির? হাসতে হাসতে কিয়েলিনিও উত্তর দিয়েছিলেন, ‘কিরিকোচ্চো’!
শব্দটা অনেকের কাছে প্রথম ঠেকতে পারে। কিন্তু এই নামটা ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন ইউরোপ থেকে শুরু করে দক্ষিণ আমেরিকায়। ফুটবল বিশ্বে এই শব্দের মত যুগান্তকারী ভয়ানক শব্দ খুব সম্ভবত তৈরিই হয়নি। আর এই শব্দের পেছনে জড়িয়ে আছে ৫০ বছর আগের এক ইতিহাস!
প্রথমেই বলে রাখা ভালো, ‘কিরিকোচ্চো’ কোনো শব্দ নয়, বরং একজন মানুষের নাম। তাও ইউরোপের নয়, বরং আর্জেন্টিনার। তার পুরো নাম জুয়ান কার্লোস কিরিকোচ্চো। আশির দশকে তিনি ছিলেন আর্জেন্টিয়ান দল এস্তুডিয়েন্টেস দে লা প্লান্টার পার ভক্ত। এতটাই বড় বক্ত যে প্রতি ম্যাচে ট্রেন ধরে এসে বসতেন খেলা দেখতে।
শুধু খেলা দেখাই নয়, খেলোয়াড়দের দেখতে ট্রেনিং দেখতেও এসে বসে থাকতেন। আশির দশকের শুরুতে এই দলের কোচ হয়ে আসেন কার্লোস বিলার্দো। আর্জেন্টিনাকে ১৯৮৬ বিশ্বকাপ জেতানো কোচ শেষ বয়সে খেলে গিয়েছেন এই দলেই। এর আগেও দুই দফা কোচিং করিয়ে গিয়েছেন। কলম্বিয়াকে বিশ্বকাপ খেলাতে না পারার দরুণ বরখাস্ত হয়ে ফেরত আসেন আবার এস্তুডিয়েন্টেসে।
এসেই এক অদ্ভুত ব্যাপার লক্ষ্য করতে লাগলেন, আগেও কোচিং করিয়ে গিয়েছেন বটে, কিন্তু ওভাবে লক্ষ্য করা হয়নি। কিন্তু যতবারই এই ছেলেটা এসে খেলা দেখে, কিংবা ট্রেনিং দেখে, ততবারই দলের কোনো না কোনো খেলোয়াড় ব্যথা পায়, কিংবা দলের অবস্থা শোচনীয় হয়ে যায়।
বিলার্দো ছিলেন বেশ কুসংস্কারী। এরকম ঘটনা চোখের সামনে ঘটতে দেখে নিশ্চয়ই তিনি চুপ করে থাকবেন না। একবার ভাবলেন তাকে যদি বহিষ্কার করে দেওয়া যায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে চিন্তা ঝেড়ে ফেললেন। আর যাই হোক দলের কোনো সমর্থককে ‘তুমি আসলেই দল খারাপ খেলে’ এই অযুহাতে মাঠ থেকে ব্যান করে দেওয়া যায় না। অন্তত ১৪ বছর ধরে শিরোপার মুখ না দেখা দল থেকে তো নয়-ই।
ফলে অন্য এক ফন্দি আঁটলেন বিলার্দো। তাকে ডেকে পাঠালেন নিজের অফিসে। টাকা আর টিকিট দিয়ে বললেন যাওয়া প্রতিপক্ষ দলের ট্রেইং দেখে আসো। তার মতে, এই অভিশাপ যেহেতু আমাদের উপর কাজ করেছে, তাহলে প্রতিপক্ষের উপরেও করতে বাধ্য। শুধু তাই নয়, তাকে রাখা হলো দলের সাথে, প্রতিপক্ষ দল যখন মাঠে আসতো, তাদেরকে বাস থেকে মাঠ পর্যন্ত রিসিভ করার দায়িত্বও দেওয়া হলো তাকে। বলতে গেলে এস্তুডিয়েন্টেসের হয়ে প্রতিপক্ষ দলের সাথে সর্বক্ষণ থাকার দায়িত্ব তার।
কিরিকোচ্চো হতাশ করেননি বিলার্দোকে। প্রতি ম্যাচেই ছিলেন প্রতিপক্ষের ছায়া হয়ে। আর সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছেন কোচ। ১৫ বছর পর এস্তুডিয়েন্টেসের হাতে লিগ শিরোপা তুলে দেন বিলার্দো। পুরো টুর্নামেন্টে মাত্র এক ম্যাচে হেরেছিলেন বিলার্দো। বলতে পারবেন সে ম্যাচে কী হয়েছিল? সে ম্যাচের আগে অসুস্থতার জন্য মাঠে যেতে পারেননি কিরিকোচ্চো। এতটাই ভয়ানক ছিল তার অভিশাপ!
বিলার্দো কোচ হিসেবে বেশিদিন ছিলেন না এস্তুডিয়েন্টেসে। তার সাফল্য দেখে আর্জেন্টিনার কোচ করা হয় তাকে। অন্যদিকে, কিরিকোচ্চোও তার কাজের প্রতিদান পেয়ে যান, তাকে করা হয় ক্লাবের মাসকট।
আর্জেন্টিনার একটা দলে জনপ্রিয় এই শব্দের ইউরোপে আসার গল্প আরো দারুণ। আর্জেন্টিনার হয়ে ৯০ বিশ্বকাপ হারার পর আবারও ক্লাব কোচিংয়ে মনোযোগ দিতে চান বিলার্দো। তখন তাকে কোচ হিসেবে নিয়ে আসে স্প্যানিশ দল সেভিয়া। আর সেখানে এসেই দলের খেলোয়াড়দের নিজের সব কুসংস্কারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকেন বিলার্দো। আর তার মাঝেই একটা ছিল কোনো খেলোয়াড় পেনাল্টি নিতে গেলে পেছন থেকে চিৎকার করে ‘কিরিকোচ্চো’ বলে ওঠা। সেটা কাজও করেছে।
খেলোয়াড়রা বলা শুরু করলে সমর্থকরা কি আর বাকি থাকে? তারাও যোগ দিয়েছিল তাদের সাথে। আস্তে আস্তে পুরো ইউরোপজুড়ে ছড়িয়ে পরে এই এক শব্দ। যা দিয়েই প্রতিপক্ষকে এক কথায় ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব। কুসংস্কারে বিশ্বাসী না হয়েও পেনাল্টি নিতে যাওয়ার আগে চিৎকার করে ওঠেন অনেকে। সেভিয়ার সমর্থকরা তো এখনও প্রতিপক্ষ পেনাল্টি নিতে গেলে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে চিৎকার করে ওঠেন ‘কিরিকোচ্চো’।
২০১০ বিশ্বকাপ ফাইনালে ক্যাপডেভিয়াকে কাটিয়ে চলে যাওয়ার চিৎকার করে রোবেনের দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন ‘কিরিকোচ্চো’! ফলাফল পাওয়া গিয়েছে কিছু সেকেন্ড পরেই। আজীবনের জন্য সেই মুহূর্তটা আফসোস হয়ে রয়েছে রোবেনের। আর ক্যাসিয়াসের জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয়!
বিলার্দো এরপর আবার ফিরেছিলেন এস্তুডিয়েন্টেসে। কোচিং ক্যারিয়ারের ইতি টেনেছিলেন তিনি সেখানেই। কিন্তু তখন বহু খুঁজেও খোঁজ পাননি কিরিকোচ্চোর। জীবনের টানে কিরিকোচ্চো হারিয়ে গিয়েছেন, কিন্তু তার নাম হারায়নি। ইউরোপের মাঠে এখনোও তার নাম আতঙ্ক ছড়ায় প্রতিপক্ষের মনে।