Social Media

Light
Dark

ডিন্ডা অ্যাকাডেমি অব ‘অধ্যবসায়’

যখন অবসর নিলেন, তখনও ক্রিকেট ক্যারিয়ারের চেয়েও বেশি আলোচিত হল অন্য একটা বিষয় নিয়ে। অশোক ডিন্ডা – দিনের পর দিন যিনি অকারণ উপহাসের স্বীকার হয়েছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। আমার এই লেখাটার পর সেই উপহাসের মাত্রা কমবে এমনটা আমি আশা করি না।

কিন্তু, আমার উদ্দেশ্য আপনারা যেই খেলোয়াড়টিকে নিয়ে নোংরা কাদা ছোঁড়াছুড়ি করছেন তাকে জানানো। অনেকেই আছেন, অশোক দিন্দাকে হয়তো ঠিকমত চেনেনও না, ক্রিকেটীয় বিচারে তাঁর মাত্রা উঁচু না নীচুতে, উঁচু হলে ঠিক কতটা উঁচুতে কিংবা নিচু হলে ঠিক কতটা নিচুতে সেটাও জানেন না। সেটা জেনে নিলেই উপহাস করতে সুবিধা হয়না?

প্রথমে পরিসংখ্যানে আসি। যে ক্রিকেটারটিকে আপনারা উপহাসের বস্তু বানিয়েছেন তাঁর নামের পাশে আছে ৪২০ প্রথম শ্রেণির উইকেট!  এই উইকেট তিনি নিয়েছেন মাত্র ১১৬ টি প্রথম শ্রেণির ম্যাচে। একজন ক্রিকেটার ৪০০-এর বেশি প্রথম শ্রেণির উইকেট পেয়ে উপহাসের যোগ্য কিনা এটা অবশ্য আমি জানিনা, আমি বরং লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে একটু মনোযোগ দেই। মনোযোগ দেওয়ার আগে একটু পূর্বকথন বলে নিই ।

অশোক দিন্দাকে উপহাস করার জন্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ‘ডিন্ডা অ্যাকাডেমি অব পেস বোলিং’ নামে একটা ‘ব্যাপার’ আছে। এখন অবশ্য নাম বদলে ফেলা হয়েছে। কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এখানে অশোক দিন্দাকেই টেনে আনা হয়। এই টেনে নেওয়ার ‘সময়কাল’ হল যখনই কোন বোলার কোন ম্যাচে অতিরিক্ত রান দিয়ে ফেলেন তখনই তাকে এই অ্যাকাডেমির সদস্য করে নেওয়া হয়। তার মানে অশোক ডিন্ডার রান দেওয়ার প্রবণতা তো বেশি থাকা উচিত তাইনা?

কিন্তু, আপনি হয়তো জানেন না ভারতের ঘরোয়া সার্কিটের মত ভীষণ কঠিন প্রতিযোগিতামূলক ক্রিকেটে খেলেও অশোক দিন্দার লিস্ট-এ ক্রিকেটের ইকোনমি রেট ৫.১৬! লিস্ট-এ ক্রিকেটে ৯৮ ম্যাচে মাঠে নেমে তিনি নিয়েছেনও ১৫১ উইকেট! এখন আপনিই বলুন, লিস্ট-এ ক্রিকেটে একজন বোলারের ইকোনমি রেট ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে যদি ৫.১৬ হয়, সেই ক্রিকেটারকে রান মেশিন আখ্যা দিয়ে কি অ্যাকাডেমি খোলা যায়? অন্য যে কেউ ম্যাচে বেশি রান দিলে তার সাথে এই ক্রিকেটারটিকে মিলিয়ে কি উপহাস করা যায়?

এখন আপনারা অশোক দিন্দার আইপিএল পরিসংখ্যান টেনে আনতে পারেন। কিন্তু, যে আইপিএল নিয়ে অশোক দিন্দাকে উপহাস করা হচ্ছে দিনভর অনেকে তো সেই আইপিএলকেই উপহাস করেন। তাহলে ব্যাপারটা অনেকটা দ্বিমুখীতা হয়ে গেল না? তবে আপনার জ্ঞাতার্থে জানিয়ে রাখি, আইপিএলের স্বল্প সুযোগে অশোক দিন্দার ইকোনমি রেট ৮.২ আর যেকোনধরণের টি-টোয়েন্টিতে যেটা ৭.৬৮!

এবার একটু পরিসংখ্যান থেকে দূরে সরা যাক। সংখ্যা কপচানো আর কতক্ষণই বা ভাল লাগে!

অশোক ডিন্ডা ক্রিকেটে উঠে আসা কিন্তু ফেসবুকে একটা পেজ খুলে ডিন্ডা অ্যাকাডেমি অব পেস বোলিং চালানোর মত সহজ ছিল না। এমনিতে পশ্চিমবঙ্গের ক্রিকেটাররা নাকি যোগ্য মর্যাদা পান না, এমন একটা মিথ চালু আছে ভারতীয় ক্রিকেটে। তাঁর ওপর অশোক ডিন্ডার জন্ম অদূরে এক গ্রাম নৈছনপুরে, কলকাতা থেকে যার সময়মাপক দূরত্ব তিন ঘণ্টা!

কলকাতা থেকে ওই তিন ঘন্টা যাত্রাপথের দূরত্ব পাড়ি দিয়ে অশোক ডিন্ডা আসতেন নেট বোলিং করতে। এরকমই নেট বোলিং করতে গিয়ে তিনি নজরে পড়ে যান কোচ অতল দেব বর্মণের। অতল দেব বর্মণ অশোক ডিন্ডাকে স্থায়ী হয়ে থেকে যেতে বলেন কিন্তু অশোক দিন্দার তখন পুরোদস্তুর ক্রিকেটার হবার মত অর্থাভাব আছে। কলকাতার মত শহরে থেকে নিজের যাবতীয় খরচ চালিয়ে ক্রিকেট খেলার মত সামর্থ্য ডিন্ডার ছিল না। আর ডিন্ডার পরিবারও ক্রিকেটের প্রতি একদমই প্রসন্ন ছিল না। ক্রিকেট খেলার দায়ে তো রীতিমত বাড়িতে অশোক ডিন্ডাকে অপমানও সহ্য করতে হত।

যা হোক, অতল দেব বর্মণ অশোক ডিন্ডার একটা ব্যবস্থা করে দেন । তিনি কালীঘাট ক্লাবে অশোক ডিন্ডার জন্যে একটা চুক্তির ব্যবস্থা করেন যাতে ক্রিকেটীয় আয়ের উৎস অশোক ডিন্ডার হাতে থাকে। কিন্তু কালীঘাটের চুক্তি দিয়ে আর কতই বা নিজেকে চালানো যায়, অশোক দিন্দার ‘সিটি অব জয়’ কলকাতাতে তখন আনন্দের ছিটেফোঁটাও  ছিল না।

কিন্তু অশোক ডিন্ডার যেটা ছিল , ক্রিকেটের প্রতি নিখাদ ভালবাসা। নিজের জীবনে তিনি এই একটা জিনিসই লালন করে এসেছেন আর তা হল ক্রিকেট আর সেই ক্রিকেটের চেরি ফলের মত বল। হ্যাঁ, হয়তো খুব বেশি প্রতিভাধর তিনি ছিলেন না। ঈশ্বর নিজের অমিত প্রতিভার ভান্ডার থেকে অশোক ডিন্ডার জন্যে হয়তো খুব কমই বরাদ্দ করে রেখেছিলেন, কিন্তু সেই প্রতিভার অভাব পূরণের মত মনোবল আর ত্যাগের মানসিকতা অশোকের ছিল।

সেই ত্যাগ নিয়েই তিনি কলকাতাতে নিজের ক্যারিয়ার চালিয়ে গেছেন ভীষণ কষ্টে। থাকার জায়গা না পেয়ে ক্রিকেট মাঠের সবুজ ঘাসে রাত কাটিয়েছেন, খাবারের অভাবে না খেয়ে থেকেছেন। বাবা-মা কখনই অশোককে ক্রিকেটার হতে সাহায্য করেনি, তবুও অমিত এই কষ্ট ছেড়ে তিনি আবার নৈছনপুরে ফিরে যাননি। তিনি পোড় খাওয়া সৈনিকের মত ময়দানে থেকেছেন, দধীচির মত সাধনা করেছেন, অস্থি দান না করতে হলেও হাড়ভাঙা খাটুনি সয়েছেন! নয়টা বছর ক্রিকেটকে ভালবেসে একটা মানুষ কি সয়েছেন আমি নিজেও হয়তো ঠাণ্ডা শীতের সকালে ল্যাপটপের কী-বোর্ডে আঙুল চালাতে চালাতে বোঝাতে পারব না!

আপনি-আমি এই গল্প না জানলেও অশোকের কাছের মানুষেরা ঠিকই জানে, ক্রিকেটটা যারা খেলে তাঁরা ঠিকই জানে। আর তাই ইসুরু উদানা টুইট করেন, আমাদের থামতে বলেন। মনে করিয়ে দেন পুরো গল্প না জেনে কাউকে বিচার করা ঠিক না । কিন্তু আমরা থামিনা, বুনো উল্লাসে দাঁত বের করে কারো ইকোনমি রেট একটু উপরে উঠে গেলেই অশোক ডিন্ডাকে টেনে নিয়ে আসি। অশোক ডিন্ডাকে নিয়ে আমাদের নোংরামি এতটাই বেড়ে যায় যে তাঁর মাথার হেয়ারব্যান্ডটাও বাদ যায়না, অশোক ডিন্ডাকে আমাদের উদ্দেশ্যে খোলা চিঠি লিখতে হয়, মনে করিয়ে দিতে হয় ঠিক কতটা কষ্ট করতে হয়েছে তাঁকে। এরপরও আপনি থামেন না। আপনি কি ক্রিকেট ফ্যান? ক্রিকেটকে সত্যি ভালবাসেন আপনি?

যেই অশোক দিন্দাকে নিয়ে আমাদের এই নিচু মানসিকতার নোংরামি সেই অশোক ডিন্ডা কিন্তু ছিলেন প্রখর ব্যাক্তিত্বের অধিকারী। বাংলা দলের কোচ পরশ মামব্রের কণ্ঠ থেকেই শোনা যাক, ‘সবচেয়ে সেরা যে জিনিসটা ওর ছিল তা ওর অ্যাটিচিউড। সে অনেক কঠিন পথ পাড়ি দিয়ে এখানে এসেছে এবং কোনকিছুই ‘টেকেন ফর গ্রান্টেড’ হিসেবে নেয়নি। সে এমন একজন যে সবসময়ই লম্বা বোলিং স্পেলের জন্যে প্রস্তুত থাকে এবং কঠোর পরিশ্রম করতে কখনই পিছপা হয়না’

অশোক দিন্দা আইপিএলে খেলেছেন এটা তো আমরা সবাই জানি। সৌরভ গাঙ্গুলীর বিশ্বাসভাজন ছিলেন তিনি। সৌরভও নতুন বল তুলে দিতেন অশোকের হাতে। এরপর হঠাৎ করেই সৌরভকে নাইট রাইডার্স থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আপামর বাঙালির অনেকেই এই বিষয়টা মানতে পারেনি। এখনও নাইট রাইডার্স শিবিরকে অনেকেই পছন্দ করেনা এই কারণে।

কিন্তু, সৌরভকে সরিয়ে দেওয়া যে ঠিক হয়নি এটা সর্বসমক্ষে প্রথম কে বলে জানেন? সেই অশোক দিন্দা। তিনিই প্রথম বলেন, কলকাতা সৌরভের অধীনে ভাল করত, উন্নতি করত। এতে অবশ্য তাকেও দল থেকে বিতাড়িত হতে হয়েছে। কিন্তু তাতে কি! ঘর বিতাড়িত ক্রিকেট-প্রেমিক এসব আর কবে ভয় পেয়েছে!

আজকের এই লেখাটি হয়তো অশোক ডিন্ডাকে নিয়ে। কিন্তু এই লেখাটি থেকে একটা বার্তা আমরা সবাই পেতে পারি। কেউ কেউ হয়তো ঈশ্বরপ্রদত্ত প্রতিভা নিয়ে পৃথিবীতে আসেনা, কিন্তু বিশ্বাস করুন এই প্রতিভা না থাকাকে চ্যালেঞ্জ জানানোর সক্ষমতা সবার থাকেনা। সেই সক্ষমতা আর সাহস যদি আর কোন অশোক দিন্দা করে থাকে প্লিজ আমরা তাকে প্রশংসা করি, অহেতুক উপহাসের পাত্র না বানাই।

ব্রায়ান লারা তাঁর অসাধারণ আর কাব্যিক এক ক্যারিয়ার শেষে বলেছিলেন, ‘আমি কি তোমাদের বিনোদন দিতে পেরেছিলাম?’ ক্রিকেটটা তো বিনোদনই। সেই নিখাদ বিনোদনে কি অশোক ডিন্ডার মত কাউকে নিয়ে নোংরামি শোভা পায়?

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link