ওরা চারজন, দ্য এন্ড গেম

চারজনের মধ্যে থেকে আপনার কাকে বেশি পছন্দ সেই নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করতে পারেন। চারজনের স্বপক্ষেই যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। সানি যেমন ওপেন করতেন বলে আলাদা পয়েন্ট দাবি করতে পারেন, তেমনি ভিভ এগিয়ে থাকবেন তার বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের জন্যে। চারজনের মধ্যে শচীনের মতো এত লম্বা সময় জুড়ে কেউ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন নি, অন্যদিকে লারার ব্যাটিং দর্শক হিসেবে আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে।

শচীনের ধারাবাহিকতা – গত ক’দিনের আলোচিত বিষয়। সব প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে, সব দেশের মাটিতে, সব পর্যায়ের বোলিংয়ের বিরুদ্ধে শচীনের মতো ধারাবাহিক সাফল্য আর কোন ব্যাটসম্যান পাননি গত পঞ্চাশ বছরে।

এবার শচীনের ক্যারিয়ারের কয়েকটি দুর্বল দিক নিয়ে আলোচনার সময়। দুটি বহুচর্চিত বিষয় হচ্ছে চতুর্থ ইনিংসে এবং ক্যারিয়রের শেষের দিকের ব্যর্থতা। প্রথমটির ক্ষেত্রে এটাই বলার যে সাধারণত চতুর্থ ইনিংসে রানও অন্যান্য তিন ইনিংসের তুলনায় কম হয়। তাই ব্যাটসম্যানের গড় চতুর্থ ইনিংসে কম হবে এটা স্বাভাবিক। লারার বা দ্রাবিড়ের গড়ও প্রথম ইনিংসের তুলনায় চতুর্থ ইনিংসে বেশ কম।

কিন্তু, এটা পুরোপুরি সত্য নয়। তথ্য বলছে প্রথম ইনিংসের তুলনায় চতুর্থ ইনিংসের গড় রান ইনিংস প্রতি পাঁচ রানের কাছাকাছি কম হয় (২০১১ অব্দি প্রথম ইনিংসের গড় রান ছিল ইনিংস প্রতি ৩২.২৭, চতুর্থ ইনিংসে সেটা নেমে দাঁড়ায় ২৭.১৭। এই সময় অব্দি প্রথম ইনিংসে মোট সেঞ্চুরির সংখ্যা ১৩৪২, চতুর্থ ইনিংসে ১৯৭।)। শচীন, লারা বা ক্যালিসের ক্ষেত্রে এই তফাতটা অনেকটা বেশি। সুতরাং চতুর্থ ইনিংসের ব্যর্থতা সচিনের ক্রিকেটের একটা দুর্বল দিক সেটা মেনে নিতে হবে।

ক্যারিয়ারের শেষের দিকে শচীনের পারফর্মেন্স বেশ খারাপ। শেষ ২৩টি টেস্টে (জানুয়ারি ২০১১র পর থেকে) তিনি মাত্র ৩২.৩৪ গড়ে ১২২৯ রান করেন। ২০০ টেস্ট এবং ১০০ আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি – এই দুটো রেকর্ডের পেছনে ছুটতে গিয়ে সচিনের সামগ্রিক ক্যারিয়রের ছবি অনেকটাই বিবর্ণ হয়েছে। এ ছাড়াও বেশ কিছু নতুন প্রতিভা হয়ত শচীনের জন্য সঠিক সময়ে সুযোগ পান নি।

আমার ব্যাক্তিগত ধারণা ছিল ২০১১ বিশ্বকাপ জয়ের পর শচীন অবসর নেবেন। সম্ভবত এই আশাটা আমার মতো অনেক ক্রিকেট প্রেমীর মনেই ছিল। সেই সময় অব্দি সচিন যে জায়গায় পৌঁছে গেছিলেন তা তার আগে আর কোন ক্রিকেটার পৌঁছাননি। ওনার লম্বা রেকর্ডের লিস্টে একটা – দুটো কম পড়লে কেউ খেয়ালই করত না।

কিন্তু সেই সঙ্গে এটাও মেনে নেওয়া উচিৎ যে নিজের ক্যারিয়ার কখন শেষ করবেন সেই বিষয়ে ডিসিশন নেবার অধিকার একমাত্র শচীনের ছিল। ওনার পারফর্মেন্স দলে থাকার মতো না হলে তাকে বাদ দেওয়ার বিকল্প তো নির্বাচকদের সবসময়ই ছিল। সুতরাং অবসর নেওয়ার সময় সঠিক না হওয়ার কারনে ক্রিকেটার সচিনের অ্যাচিভমেন্ট এক চুলও কমে যায় না।

আমরা যারা রুপোলী পর্দায় অমিতাভ বচ্চনের আধিপত্য দেখেছি, তাদের কাছে তার ছোটখাটো রোল অথবা কমার্শিয়াল করা না ভালো লাগতেই পারে কিন্তু তাতে তার সেরা সময়ের সিনেমাগুলির মান কমে যায় না। কয়েকবছর আগে লতা মঙ্গেশকর কোলকাতায় এসেছিলেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তার একনিষ্ঠ ভক্ত আমার মায়ের জন্যে টিকিট জোগাড় করেছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে মা বেশ মুষড়ে পড়ে। আমি কারণ জিজ্ঞেস করায় উত্তর দিয়েছিল, ‘আমি যে কোনদিন লতার গলা থেকে বেসুরো গান শুনবো সেটা কল্পানা করতে পারি নি। না গেলেই ভালো হত।’

আমাদের দেশ ব্যাক্তিপুজোয় বিশ্বাস করে। মানুষের মধ্যে ভগবান দেখা আমাদের জিনে রয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বিখ্যাত মানুষদের স্তাবকের দল। আপনার চারপাশের মানুষেরা যদি বারবার আপনাকে বোঝাতে থাকেন যে আপনার অভিনয়, গান বা ব্যাটিং এখনও দারুণ হচ্ছে, আপনি সেটা বিশ্বাস করতে চাইবেন। বিশেষ করে যদি আপনার জানা থাকে যে আপনি অবসর নেওয়ার পরমুহূর্ত থেকে আপনার ব্র্যান্ড ভ্যালু আছড়ে পড়বে।

অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ড বা নিউজিল্যান্ডের মতো দেশে এই সমস্যা নেই। সেখানে ক্রিকেটারদের আমাদের মতো অস্বাভাবিক উচ্চতায় ওঠানো হয় না। অবসর নেওয়ার পরও তাদের জীবনযাত্রায় খুব একটা প্রভাব পড়ে না। তাই তাদের পক্ষে উচ্চতায় থাকা অবস্থায় অবসর নেওয়া অনেক সহজ।

আমি এতক্ষন ধরে যা করলাম তা শচীনের ক্যারিয়ার টেনে নিয়ে যাওয়ার সমর্থন নয়, ব্যাখ্যা। দুটোর মধ্যে তফাতটা আশাকরি পাঠকেরা ধরতে পারবেন। আরও একটা ছোট্ট অ্যানালিসিস দিয়ে শেষ করি। আগের লেখায় বিদেশে ভালো বোলিঙের বিরুদ্ধে চারজনের পারফর্মেন্সের তুলনা করেছিলাম। এবার দেখার চেষ্টা করব আলোচ্য চার ব্যাটসম্যান একার প্রচেষ্টায় দলকে কতবার টেনে নিয়ে গেছেন। এবং সেই ম্যাচগুলির কী ফল হয়েছে।

একার প্রচেষ্টা বলতে একটা ইনিংসে দলের অন্তত ৪০% রান সহ সেঞ্চুরি করেছেন এমন ইনিংসগুলি ধরা হবে। সেই ইনিংসগুলিতে দলের অন্তত আট উইকেট পড়তে হবে তবেই সেটা সম্পূর্ণ ইনিংস হিসেবে ধরা হবে।

এই ধরনের ইনিংস সবচেয়ে বেশি খেলাছেন ব্রায়ান লারা। নেই নেই করে তার ১৫টি সেঞ্চুরির ক্ষেত্রে দেখা গেছে যে তার স্কোর দলের ৪০% বা তার বেশি। এই ১৪টি টেস্টের মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে দুটো টেস্টে জেতাতে পেরেছেন লারা, হার ১০টি তে, ড্র ২টিতে। এর মধ্যে মোট পাঁচবার ওয়েস্ট ইন্ডিজের মোট রান ৩০০র কম ছিল। এই পরিসংখ্যান বলে দেয় সেই সময়ের ওয়েস্ট ইন্ডিজ কতটা লারা নির্ভর ছিল।

এর মধ্যে ওল্ড ট্র্যাফর্ডে ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে এবং কলম্বোয় শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে দুই ইনিংসেই ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ৪০% এর বেশি রান করেও দলকে পরাজয় থেকে লারা বাঁচাতে পারেন নি। এবং যে দুটি জয় এনে দিয়েছেন সেগুলি ১৯৯৯ সালের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে – বোলারদের নাম ম্যাকগ্রা, ওয়ার্ন, গিলেস্পি এবং ম্যাকগিল। লারার এই দুটি ইনিংস (১৫৩ এবং ২১৩) ক্রিকেটে অমরত্ব লাভ করেছে।

সানির খেলা এরকম টেস্টের সংখ্যা আট। এর মধ্যে তিনটে ম্যাচে ভারত হেরেছে, বাকি পাঁচটা ড্র। ১৯৭৮এর করাচি টেস্টে ইমরান – সরফরাজদের বিরুদ্ধে দুই ইনিংসে সেঞ্চুরি করেও দলকে বাঁচাতে পারেন নি সানি। এই নয়টি ইনিংসের মধ্যে দুটি এমন ইনিংস ছিল যেখানে দলের স্কোর ৩০০র কম ছিল। সব মিলিয়ে এই স্ট্যাট এই যুক্তি সমর্থন করে না যে সানি ভারতের ব্যাটিং বহুদিন ধরে একা টেনেছেন।

ভিভের খেলা এই ধরনের ইনিংসের সংখ্যা আরও কম – সাতটি। এর মধ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের জয় দুটো, পরাজয় একটা (ভারতের বিরুদ্ধে ১৯৭৬ সালে পোর্ট অফ স্পেনে), বাকিগুলি ড্র। এর মধ্যে মাত্র একটা ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩০০র কম রানের অল আউট হয়। অর্থাৎ, খুব বাজে উইকেটে একা দলকে পরিত্রাণ করেছেন – এরকম পরিস্থিতি ভিভের জীবনে বেশিবার আসে নি।

সবশেষে শচীন। মোট বারোবার শচীনের সেঞ্চুরি দলের মোট স্কোরের ৪০% বা তাঁর বেশি ছিল। এর মধ্যে ভারতের জয় ৩টি, হার ৭টি এবং ড্র মাত্র ২টি টেস্টে। তিনটি জয়ের মধ্যে দুটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে, একটি অস্ট্রেলিয়া। তবে এর মধ্যে ছটা ইনিংসে ভারতের মোট স্কোর ৩০০ পেরোয়নি। সচিনের জীবনের সেরা কয়েকটি ইনিংস এই ধরনের টেস্টগুলিতে পাবেন – পার্থে ১১৪, জ’বারগে ১১১, এজবাস্টনে ১২২, চেন্নাইয়ে ১৩৬ ও মেলবোর্নে ১১৬। সবগুলিই ১৯৯২-১৯৯৯ এর মধ্যে খেলা। এই সময়টা ভারতের ব্যাটিং অনেকটাই সচিন নির্ভর ছিল।

তবু সবমিলিয়ে এই ক্রাইটেরিয়ায় লারাকেই এগিয়ে রাখতে হবে কারণ তিনি প্রায় পুরো ক্যারিয়ার জুড়েই ওয়ান ম্যান আর্মির রোল প্লে করে গেছেন। দ্বিতীয় স্থানে শচীন থাকবেন। ভিভ সবচেয়ে কম চাপ নিয়ে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছেন তবে শক্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে একমাত্র জয় ভিভের ব্যাট থেকেই এসেছে (সচিনের দুটো জয় বাংলাদেশের মাটিতে)। এই টেস্টে দলের মোট ৬৮৭ স্কোরের মধ্যে ২৯১ করেন ভিভ। অর্থাৎ উইকেট মোটামুটি ব্যাটিং সহায়ক ছিল।

শচীনের ক্ষেত্রে একটা বড় সমালোচনা হোল উনি বিদেশের মাটিতে ব্যাক্তিগত পারফর্মেন্সের জোরে ভারতকে কোন জয় এনে দিতে পারেন নি। এখানে দেখতে পাচ্ছি এই কাজে অন্য তিনজনের রেকর্ডও তেমন সুবিধের নয়। অর্থাৎ শক্ত প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিদেশের মাটিতে দেশকে জয় এনে দেওয়া খুব একটা সহজ কাজ নয়। আর এজন্যেও যারা বিদেশের মাটিতে এই কাজ দুই – একবারও করেছেন (লক্ষণ, বিশ্বনাথ, পন্থ), তারা আলাদা সম্মান দাবি করতে পারেন।

আমার কথাটি ফুরোল। এবার চারজনের মধ্যে থেকে আপনার কাকে বেশি পছন্দ সেই নিয়ে আলোচনা আরম্ভ করতে পারেন। চারজনের স্বপক্ষেই যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে। সানি যেমন ওপেন করতেন বলে আলাদা পয়েন্ট দাবি করতে পারেন, তেমনি ভিভ এগিয়ে থাকবেন তার বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের জন্যে। চারজনের মধ্যে শচীনের মতো এত লম্বা সময় জুড়ে কেউ ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে পারেন নি, অন্যদিকে লারার ব্যাটিং দর্শক হিসেবে আমাকে সবচেয়ে বেশি আনন্দ দিয়েছে।

আলোচনা চলুক কিন্তু খেয়াল রাখবেন নিজের পছন্দের ক্রিকেটারকে উঁচু স্থান দিতে গিয়ে যেন অন্যদেরকে নিচু করার চেষ্টা করবেন না। আর কিছু না, তাতে আমরা নিজেদেরই ছোট প্রমান করে বসব। সেই সঙ্গে সুস্থ আলোচনার পরিবেশও নষ্ট হবে।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...