Social Media

Light
Dark

ক্যারিবিয়ান দানব ও মায়াবি ব্রিটিশ

অ্যান্টিগা-বার্বাডোজ, ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগো, জ্যামাইকা, গ্রেনাডাসহ একগুচ্ছ দ্বীপ নিয়ে উত্তর আটলান্টিক আর ক্যারিবিয়ান সাগরের ওপর গড়ে উঠেছে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জ ৷ পৃথিবীর অন্যান্য দেশ ও জাতির নিরিখে ক্যারিবিয়ানদের বৈচিত্র সর্বাধিক।

খ্রিস্টান, হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, জুডিস্টসহ অসংখ্য ধর্ম, স্প্যানিশ, ইংলিশ, ফ্রেঞ্চ, ডাচসহ অজস্র ভাষার সমাবেশ দেখা যায় ক্যালিপসো মিউজিকের দেশে। তিন শতক ধরে কলোনিয়াল স্ট্রাকচার থাকায় পৃথিবীর বিভিন্ন জাতির বৈচিত্র ধারণ করেছে কালো হীরের দেশ।

সতেরো শতকের শুরু থেকেই ইউরোপীয় সভ্য দেশগুলিতে দাস হিসেবে নিয়ে যাওয়া হত ক্যারিবিয়ানদের। ফ্রান্স আর নেদারল্যান্ডসের চেয়ে ব্রিটিশদের প্রভাব আঠারো শতকে সর্বাধিক পড়ল ক্যারিবিয়ানদের ওপর। ব্রিটেনে শিল্প বিপ্লবের একটি কারণ যদি মধ্যপ্রাচ্য ও প্রাচ্যের ধনসম্পদ লুট হয় তবে অন্য কারণটি অবশ্যই ক্যারিবিয়ান শ্রমিকদের অমানুষিক পরিশ্রম।

ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে অল্প পারিশ্রমিকে হাজার হাজার ক্রীতদাস এনে কারখানার কাজে লাগাত ব্রিটিশরা, সামান্য খাদ্যের লোভে নিজেদের দানবিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে দিতেন ক্যারিবিয়ান ক্রীতদাসরা। কালো শ্রমিকদের মনে জমা হত ব্রিটিশ প্রভুদের প্রতি তীব্র ঘৃণা।

সামারসেটের হয়ে প্রথম কাউন্টি মরশুন খেলতে এসে বেজায় সমস্যায় পড়েন বিশ্বত্রাস ব্যাটসম্যান ৷ থাকার জায়গা না পেয়ে নাজেহাল স্যার ভিভ রিচার্ডস। এ সময়ে সামারসেটের হয়ে খেলতে এলেন নবাগত তরুণ অলরাউন্ডার স্যার ইয়ান বোথাম। সামারসেট দলের গোঁড়া ব্রিটিশ ম্যানেজমেন্ট চট করে ক্যারিবিয়ানদের সাথে ভাল ব্যবহার করতেন না।

কিন্তু, বোথাম ভিভের অসহায়ত্ব দেখে কাঁধে হাত রাখলেন। ব্রিটিশ মানসিকতার কাটো ভাঙা যুবরাজ বথাম পাল্টে দিলেন একটা বেপরোয়া ক্যারিবিয়ান মানুষকে। একটি একতলা বাড়িতে শুরু হল এক নতুন অধ্যায়। ভিভের দিলদরিয়া মন আর বথামের উদার মানসিকতা মিলে মিশে সামারসেটের সেই ছোট্ট ঘর থেকে রাতে ভেসে আসতে লাগল বন্ধুত্বের স্যাক্সোফোন।

যে ভিভ মিডিয়ার সামনে অকপটে বলতেন ব্রিটিশদের ঔদ্ধত্য দেখে আমার মাথা ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে সেই ভিভ রাতে ক্যালিপসো গান শোনাতে শুরু করলেন বন্ধু বথামকে। বোথামের অলরাউন্ড পারফরম্যান্স ঝড় তুলল সমারসেট দলে, ভিভ আর বথাম সমারসেটের হয়ে যেন আগুন ঝরাতে শুরু করলেন।

দিনে একসাথে কিট ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ক্রিকেট,বিকেলে হাফপ্যান্ট পরে ব্রিটেনের রাস্তায় ঘুরে বেড়াতে লাগল দুই ক্রিকেটের যুগপুরুষ, রাতে আরেক বন্ধু গ্রাহাম স্টিভেনসন এলে হাসি আর মজায় জমে উঠত আসর।

সকালে প্র‍্যাকটিসে বথাম নিজের সর্বশক্তি দিয়ে হিট করতেন লাল বলকে, ভিভ আরও জোড়ে – দুই বন্ধু এক প্লেট সসেজের বাজি নিয়ে লম্বা ছক্কা মারার খেলায় মেতে উঠত, ভিভের কাছে হেরে গিয়েও হাসতে হাসতে বথাম বলতেন, ‘আই হিট দ্যাট হার্ড, বাট ভিভ ডিড ইট হার্ডার।’

দেশের হয়ে বার্বাডোজে খেলতে গেলে বথাম আর তার পরিবারের আস্তানা হত ভিভের আন্টিগুয়ার বাড়ি, টিম হোটেল থেকে বন্ধুকে প্রায় হানা দিয়ে তুলে আনতেম ভিভ, কে বলবে পরদিন তারাই প্রতিপক্ষ?

১৯৮৭ সালে পিটার রোবাক্স সমারসেটের হর্তাকর্তা ও অধিনায়ক হয়ে দল থেকে ছেঁটে দিলেন ভিভ আর জোয়েল গার্নারকে। তার বদলে কিউই মার্টিন ক্রোকে দলে নিলেন তিনি৷ ভিভ মুষড়ে পড়লেন। ভিভের এই অপমান মানতে পারলেন না টপফর্ম-এ থাকা বথাম।

বন্ধুর অপমানের প্রতিবাদে সামারসেটের সাথে প্রায় ১২ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন করে বোথাম যোগ দিলেন চিরশত্রু ওয়ারচেস্টারশায়ারে। এই ঘটনার পর কেঁদে ফেলেছিলেন লৌহমানব ভিভ রিচার্ডস। বার্বাডোজ বা পোর্ট অব স্পেন টেস্টে হাফ সেঞ্চুরি করেও বন্ধু বোথাম প্রতিপক্ষে থাকায় সেলিব্রেশন করেননি ক্রিকেটের কালো হীরা।

সময়ের স্রোত বয়ে যায় অবিরাম, তাকে বাঁধার সাধ্যি নেই কারও। কালের নিয়মে ভিভ আর বোথাম সরে গিয়েছেন মিডিয়ার লাইমলাইট থেকে, বাইশগজ জুড়ে থেকে গিয়েছে তাদের বন্ধুত্বের শামিয়ানা। এই বন্ধুত্ব শুধু দুটো মানুষ নয় বাইশগজ পেরিয়ে দুটো একেবারে ভিন্ন জাতির, দুটো বর্ণের, দুটো মানসিকতার বন্ধুত্বের সোপান লিখেছিল এক যুগ ধরে, আজও তাই ক্রিকেটে বন্ধুত্বের কথা এলে প্রথম দুটো নাম হয় ভিভ-বোথাম!

ভিভ জানেন বেলা পড়ে আসছে, বোথামের হাতে আরও শক্ত করে চেপে ধরছেন নিজের হাত। মিডিয়ার সামনে তাই প্রায় ত্রিশ বছর পর এক ভিভ অকপটে বলেন, ‘আমাদের বয়স হচ্ছে, আমরা জানি না কে আগে যাব, তবে যেই আগে যাই অন্যজনের কাঁধে নিজের পরিবার আর অসমাপ্ত ইনিংসের দায়িত্ব তুলে দিয়ে যাব।’

ক্রিকেটের নীল আকাশে স্পষ্ট হয় দুই অবয়ব। দুই বন্ধুর গল্পে আলো জ্বলে ওঠে দিগন্ত জুড়ে, সেই আলোয় ক্রমশ মিলে যেতে থাকে দেশ, কাল, সময় আর টুকরো টুকরো ইতিহাস খণ্ড।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link