চ্যাড সেয়ার্স কখনোই ভাবেননি ক্রিকেট বিশ্বকাপগামী দলের অংশ হবেন। তিনি সবসময় কেবল বিশ্বকাপের স্বপ্নই দেখেছেন। তিনি সেরা সব ক্রিকেটারদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করার স্বপ্ন দেখে বেড়ে উঠেছেন। কিন্তু দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার এই তরুণের কাছে সুযোগটা যে এভাবে আসবে সেটা বোধহয় তিনি কল্পনা করেননি। তাই যখন তার কাছে পাপুয়া নিউগিনির সহকারি কোচ হবার প্রস্তাব আসে, তিনি আনন্দে লাফিয়ে উঠেন। তিনি সুযোগটা লুফে নিতে দুবার ভাবেননি।
‘নিজের প্রথম কোচিং অভিজ্ঞতা হিসেবে টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের চেয়ে মধুর কিছুই হতে পারতো না। বিশেষ করে বিশ্বসেরা সব কোচরা তাদের দলকে নিয়ে সেখানে খেলবেন। আমার কাছে মনে হচ্ছে আমি এখনো স্বপ্নের মধ্যে আছি’, অ্যাডিলেডে নিজের বাড়িতে বসে এভাবেই অভিব্যক্তি প্রকাশ করছিলেন সেয়ার্স।
স্বাভাবিকভাবেই সেয়ার্সকে রাজি করাতে গ্রেগ ক্যাম্পবেলের বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি। সাবেক অস্ট্রেলিয়ান পেসার ক্যাম্পবেল প্রায় এক দশক ধরে পাপুয়া নিউগিনির ডিরেক্টর অব ক্রিকেট হিসেবে নিযুক্ত আছেন। আগে থেকেই তিনিই সেয়ার্সকে পছন্দ করতেন। তাই যখন পাপুয়ার জন্য সহকারি কোচের প্রয়োজন হল, প্রথমেই তার মাথায় সেয়ার্সের নামই এসেছিল।
“ক্রিকেট থেকে অবসর নেবার পর আমি যেকোনোভাবে ক্রিকেটের সাথেই যুক্ত থাকতে চাচ্ছিলাম। ক্রিকেট আমাকে সবকিছু দিয়েছে। আমি চেয়েছিলাম খেলা ছাড়ার পর কিছুটা হলেও যেন ফিরিয়ে দিতে পারি। কোচিং পেশাটাকে আমি অসম্ভব পছন্দ করতাম। তাই গ্রেগ যখন আমাকে প্রস্তাব দেয় বিশ্বকাপগামী দলের অংশ হবার তখন আমি হ্যাঁ ব্যতীত অন্য কিছু চিন্তাও করতে পারিনি” জানান উচ্ছ্বসিত সেয়ার্স।
সেয়ার্সের জন্য এবারের মৌসুমটা ছিল আবেগী। টানা এক দশক ক্রিকেট খেলার পর নিজের প্রদেশের ইতিহাসের তৃতীয় সর্বোচ্চ উইকেটশিকারি হিসেবে ক্রিকেটকে বিদায় জানান তিনি। অবসরের পর নিজের পরিবারের সাথে সুন্দর সময় কাটাচ্ছিলেন তিনি। বোধহয় টানা বোলিং করার ক্লান্তি মেটাতে এই অবসরটা সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল তার জন্য। তার ভাষ্যমতে, ‘আমি এখন বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক বেশি চনমনে অনুভব করছি।’
মৌসুম শুরুর আগের কঠিন প্রশিক্ষণ থেকেও রক্ষা পেয়েছেন তিনি। খেলা শুরুর পূর্বে ক্যাঙ্গারু দ্বীপে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো প্রাদেশিক দলের সবাইকে, ‘দলের সবাই অনুশীলন শিবিরে যোগ দিচ্ছিলো। কেবল অবসর নেবার ফলে আমিই বাড়িতে ছিলাম। এটা কিছুটা অদ্ভুত যাদের সাথে আপনি এক দশক ধরে আছেন তাদের সাথে যোগাযোগ করতে না পারা।’
সেয়ার্স আগে কখনো পাপুয়া নিউগিনিতে যাওয়া তো দূরে থাক কখনো পাপুয়া নিউগিনির খেলাও খেলাও সেভাবে মনোযোগ দিয়ে দেখেননি। তবে তিনি মনে করতে পারেন ২০১৩ সালের সময়কার কথা যখন পাপুয়া নিউগিনি জাতীয় দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার প্রাদেশিক একদিনের টুর্নামেন্টে অংশ নিত। তার স্মৃতিতে পাপুয়া এমন এক দল যারা যেকোনো পর্যায়ের ক্রিকেটে মাঠে খুব চনমনে, এনার্জেটিক থাকতো এবং নিজের সর্বোচ্চটা দেবার জন্য চেষ্টা করতো। ক্রিকেট খেলাটা তারা খেলতো হৃদয় দিয়ে এবং সর্বদা ক্রিকেটীয় চেতনা সমুন্নত রাখার চেষ্টা করতো।
তিনি বলেন, ‘তারা সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্রিকেট খেলার মতো পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা পেতো না। তাদের ক্রিকেটীয় অবকাঠামোও ততটা উন্নত নয়। কিন্তু তারা মাঠে সবসময় নিজেদের ১২০ শতাংশ দেবার চেষ্টা করে।’
২০১৩ এবং ২০১৬ সালে দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার লিগে খেলা খেলোয়াড়েরাই এখনো পাপুয়া নিউগিনি দলের মূল শক্তি। বর্ষীয়ান চার্লস আমিরি যিনি সেসময় দলের অধিনায়ক ছিলেন, এখনো নিয়মিত রানের মাঝেই আছেন কিংবা টনি উরা যিনি তাদের মূল বোলার। বর্তমান অধিনায়ক আসাদ ভালাও যথেষ্ট কার্যকরী ক্রিকেটার। সেয়ার্স এখনো দলের সবার সাথে কথা বলেননি। তার কথাবার্তা এখনো দলের ম্যানেজমেন্ট এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাতেই সীমাবদ্ধ। তাদের প্রধান কোচ হচ্ছেন সাবেক অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত ইতালিয় অধিনায়ক পল স্যান্দ্রি যিনি নিজেও সেয়ার্সের সাথে কাজ করার জন্য মুখিয়ে আছেন।
সেয়ার্সের পাপুয়া নিউগিনি মিশন শুরু হবে আগস্টের শেষে ওমানে। সেখানে পাপুয়া স্বাগতিক ওমান এবং স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে একদিনের সিরিজ খেলবে। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের শেষমুহূর্তের প্রস্তুতি সারার জন্য সেটাই তাদের একমাত্র সুযোগ।
তিনি বলেন, ‘আমি এখনো তাদের সবাইকে চিনে উঠতে পারিনি। কোভিডের কারণে দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা থাকায় আমি এখনো দলের সাথে যুক্ত হতে পারিনি। তাই আমি অনলাইনেই সবার সাথে যোগাযোগ করছি। সবার সাথে একটা ভালো বোঝাপড়া তৈরি হলে উভয়পক্ষেরই কাজ করতে সুবিধা হবে। একবার দলের সাথে যুক্ত হতে পারলেই আমি কাজে নেমে পড়বো।’
যদিও সেয়ার্স অনেক আগে থেকেই তরুণ ক্রিকেটারদের মেন্টরিং করতে অভ্যস্ত। রেডব্যাকসে অনেক বছর ধরেই তরুণ ক্রিকেটারদের পরামর্শদাতা তিনি। তিনি নিজেকে ট্যাকটিক্স নির্ভর কোচ হিসেবে পরিচয় দিতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। খেলার টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলোর চাউতে ট্যাকটিক্যাল বিষয়গুলোতে উন্নতির দিকেই বেশি মনোযোগ তার। তিনি বিশ্বাস করেন যারা ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক বেশি ম্যাচ খেলেছেন তারা জানেন ঠিক কোন জায়গাতে ঘাটতি রয়েছে এবং কোথায় উন্নতির জায়গা সবচেয়ে বেশি।
সেয়ার্স নিজের প্রদেশের হয়ে কখনো টি টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেননি। টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপগামী কোনো দলের কোচ হিসেবে তিনি নিতান্তই অনভিজ্ঞ। তিনি সেয়ার্স এটা নিয়ে বিন্দুমাত্র চিন্তা করতে নারাজ। তার ভাষ্যমতে যেকোনো ফরম্যাটেই ক্রিকেটের বেসিক ব্যাপারগুলো একই থাকে। প্রচুর ম্যাচ খেলার সুবাদে তিনি জানেন শর্টার এই ফরম্যাটে ঠিক কোথাও বোলারদের মনোযোগ দেয়া উচিত।
তিনি বলেন, ‘টি টোয়েন্টি ট্যাকটিক্যাল একটি খেলা। যদিও আমি রেডব্যাকসের হয়ে কোনো টি টোয়েন্টি খেলিনি কিন্তু ক্লাব পর্যায়ে আমার খেলার অভিজ্ঞতা আছে। আপনাকে নিজের মাথা খাটিয়ে বল করতে হবে। ব্যাটসম্যান কি করতে চাচ্ছে সেটা আগেও ধারণা করতে হবে এবং সে অনুযায়ী বল করতে হবে। তবেই আপনি সফল হবেন। আপনি পাপুয়ার বোলারদের সেটাই শেখাতে যাচ্ছি কিভাবে তারা মাঠে এই ব্যাপারগুলো সঠিকভাবে প্রয়োগ করবে।’
পাপুয়া নিউগিনির কোচিং স্টাফে সেয়ার্সই প্রথম অজি পেসার নন। ক্যাম্পবেলের সুবাদে এর আগে জো ডৌস এবং জেসন গিলেস্পির মতো পেসার কাজ করে গেছেন পাপুয়াতে। সেয়ার্স নিজেও তাদের সাথে কথা বলেছেন পাপুয়াতে দলের সাথে যোগ দেবার পূর্বে।
টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রথম পর্বে পাপুয়া নিউগিনি পড়েছে কঠিন এক গ্রুপে। তাদেরকে মুখোমুখি হতে হবে বাংলাদেশ, স্কটল্যান্ড, ওমানের মতো শক্তিশালী প্রতিপক্ষের। তবে সেয়ার্স বিশ্বাস করেন নিজেদের প্রথম অংশগ্রহণেই পাপুয়া নিউগিনি সবাইকে চমকে দেবে।
নিজের বিশ্বকাপ স্বপ্ন পূর্ণ হবার পর সেয়ার্স বিশ্বাস করেন তাদের যাত্রা প্রথম রাউন্ডেই শেষ হবে না। তবে সেয়ার্স পরবর্তী রাউন্ডে যাবার ব্যাপারে খুব বেশি না ভেবে প্রতি ম্যাচেই উন্নতি করতে চান। পাপুয়া নিউগিনি কতদূর যাবে সেটা নিয়ে না ভেবে তিনি বরং খুশি এই ভেবে অন্তত একটা বিশ্বকাপগামী দলের কোচ তো তিনি হতে পেরেছেন।