সাবধান শামিম, সামনে পিচ্ছিল সড়ক

শামিম, আক্ষরিক অর্থেই আপনার সামনে এখন দারুণ পিচ্ছিল সড়ক। আপনার এখন হারিয়ে যাওয়ার অনেক রাস্তা। আপনি এখন সওয়ার হয়েছেন এক পাগলা ঘোড়ার পিঠে। সামান্য একটু বেখেয়াল হলেই আপনি এখন কালের গহবরে হারিয়ে যাবেন।

প্রিয় শা,ম হোসেন পাটোয়ারি,

আপনি যা করেছেন, তাতে আপনাকে একটা অভিনন্দন তো জানানো যেতেই পারে। হোক দলটা জিম্বাবুয়ে। তার বিপক্ষেই বা এমন দাপট আমরা টি-টোয়েন্টিতে কবে দেখাতে পেরেছি? রোজ রোজ তো আমাদের লোয়ার অর্ডারে এমন দানবীয় ব্যাটিং দেখতে পাই না। তাই আর সবার মত আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।

আমরা জানতাম, আপনি এরকমই কিছু করার জন্য ক্রিকেটে এসেছেন। সেই অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে ঝড়ের মত এক ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলেন। সেই প্রথম আপনাকে নিয়ে লিখেছিলাম। এরপর থেকে এই জাতীয় দলে সুযোগ পাওয়া পর্যন্ত কতবার দেখতে হলো, লিখতে হলো। ফলে আপনার এমন কিছু করার ক্ষমতাটা আমাদের অবাক করেনি।

যেটা নিশ্চিত করেছে যে, আপনি নিজের পারফরম্যান্সটাকে অবলীলায় সিনিয়র লেভেলে নিয়ে আসতে পেরেছেন। যেটা আপনার পূর্বসুরীরা অনেকেই পারেনি। প্রবল সম্ভাবনা নিয়ে এসেও সেই পারফরম্যান্স সিনিয়র লেভেলে তারা কী এক কারণে অনুবাদ করতে পারেনি, আপনার ক্ষেত্রে সেটা ঘটেনি। আপনি বুঝিয়ে দিলেন, আপনি এখানেও পারবেন।

আপনাকে অভিনন্দন, শামিম। তবে ভাই, অভিনন্দনের চেয়ে সাবধানবানী একটু বেশি শোনাই।

শামিম, আক্ষরিক অর্থেই আপনার সামনে এখন দারুণ পিচ্ছিল সড়ক। আপনার এখন হারিয়ে যাওয়ার অনেক রাস্তা। আপনি এখন সওয়ার হয়েছেন এক পাগলা ঘোড়ার পিঠে। সামান্য একটু বেখেয়াল হলেই আপনি এখন কালের গহবরে হারিয়ে যাবেন।

উদাহরণ আপনার চোখের সামনেই আছে। আপনার সিনিয়র সাব্বির রহমান রুম্মান বা নাসির হোসেনের নাম নিশ্চয়ই জানেন। পরিচয়ও থাকতে পারে। দু জনই আপনার চেয়ে বেশি হইচই ফেলে দিয়েছিলো জাতীয় দলে এসে। নাসির তো আপনার অনেক আগে গায়ে ‘ফিনিশার’ তকমাও লাগিয়ে ফেলেছিলেন। কিন্তু ঘোড়াটা নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কোন এক খাদে পড়ে গেছেন। এখন ফিনিশ হয়ে যাওয়া নাসিরের কেউ খবর রাখে না।

সাব্বির আপনার জন্য আরও ভালো উদাহরণ হতে পারেন। সাব্বির জাতীয় দলে আসার আগেই, ঠিক আপনার মত তাতে নিয়ে হইচই হচ্ছিলো। জাতীয় দলে এসেও কী সব ইনিংস খেললেন। লোকে তাকে বাংলার ম্যাক্সওয়েল বলে ফেললো।

সহ্য হলো না। এই হঠাৎ পাওয়া খ্যাতি আর অর্থ সইতে পারলেন না সাব্বির। তিনিও মাঠের বাইরের জীবনের ঘোড়াটাকে সামাল দিতে না পেরে হারিয়ে গেলেন।

আপনার সামনে এখন হারানোর অনেক সুযোগ, শামিম।

প্রথমত আপনি এখন স্বাধীন হয়ে গেলেন। অনুর্ধ্ব-১৯ দলে আপনাদের দেখে রাখার জন্য এক দল কড়া মাস্টার ছিলো। একটা দিনও তাদের চোখের আড়ালে যাওয়ার সুযোগ ছিলো না। সিনিয়র পর্যায়ে কাউকে এভাবে দেখে রাখা যায় না। এটাই কিশোরদের সাথে সিনিয়রদের পার্থক্য। এখানে খেলার সময়টুকু ছাড়া আপনাকে ক্যাডেটদের মত করে কেউ পাহারা দিয়ে রাখবে না। আপনার নিজেরই নিজের জীবনটাকে শাসন করতে পারতে হবে।

আপনি বড় হয়ে গেলেন, শামিম। এখন নিজের দায়িত্ব নিতে হবে।

আপনার সামনে এখন টাকার হাতছানি আসবে। আপনার যে চাবুকের মত ব্যাটিং স্টাইল, তাতে আপনার আইপিএলেও ডাক আসতে পারে। সিপিএল, এলপিএল, পিএসএল তো খেলবেনই। আপনার অ্যাকাউন্ট আগামী বছরের মধ্যেই ফুলে ফেঁপে উঠবে। এই টাকাকে কাগজ বলে গণ্য করতে শিখতে হবে, শামিম।

আপনার আগে আমরা জাতীয় দলে অনেককে উচ্ছনে যেতে দেখেছি কেবল এই টাকাগুলোকে ওড়ানোর সামগ্রী হিসেবে ভাবতে গিয়ে। বিপিএলে আপনার সিনিয়র অনেকে হোটেলে যাচ্ছেতাই কেলেঙ্কারি করেছেন। দেশসেরা পেসার হওয়ার সম্ভাবনা নিয়েও হারিয়ে গেছেন এমন খেলোয়াড় চিনি।

আপনার পা পিছলানোর পথ তৈরি হয়েই গেছে। আপনাকে নিয়ে এখন আমরা সাংবাদিকরা আরও বেশি হই চই করবো। আপনাকে নিয়ে নিউজের পর নিউজ হবে, গল্পের পর গল্প লেখা হবে। আপনার এখন বিশাল এক ভক্তকূল তৈরী হবে। ফেসবুকে আপনার নামের আগে বিশেষন বসবে-নয়া ফিনিশার। আজ সকালেই দেখলাম, আপনার নামে অন্তত ১০টি ফেসবুক ফ্যান গ্রুপ খোলা হয়ে গেছে। এই সংখ্যাটা আপনি দেশে ফিরতে ফিরতে আরও বাড়বে।

এসব থেকে আপনার নিজেকে বাচিয়ে রাখা শিখতে হবে।

অবশ্য, এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। নিজেকে সামলানোর পথটাও আপনি পাশেই খুজে পাবেন। আপনার সৌভাগ্য যে, আপনি যে দলে এখন খেলছেন, সেখানেই আছেন মুশফিকুর রহিম, তামিম ইকবাল, মাহমুদউল্লাহ এবং সাকিব আল হাসানের মত  সব উদাহরণ। আপনি চাইলেই তাদের থেকে শিখতে পারেন, নিজেকে কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়।

এই মানুষগুলো দেশের জন্য, ক্রিকেটের জন্য কী করেছেন, সে আলাপ বাদ দিন। শুধু জানুন, এরা ১২ বছর ধরে সেরা স্তরে ক্রিকেট খেলছেন। কখনো তাদের কাউকে নিয়ে একটা স্ক্যান্ডাল তৈরী হয়নি। এরা কেউ কখনো পিচ্ছিল এই রাস্তায় একবারও পা পেছলাননি।

আপনি মুশফিকুর রহিমের কাছ থেকে জানতে পারবেন, কিভাবে নিজেকে সর্বোচ্চ শৃঙ্খলায় বেঁধে রাখতে হয়। আপনি সাকিব আল হাসানের কাছে জানতে পারবেন, কিভাবে দুনিয়ার সব আলো নিজের  ওপর থাকার পরও চোখ ঝলসানো থেকে বেচে থাকতে হয়। আপনাকে শিখানোর লোকের অভাব নেই।

কেবল আপনি সঠিক লোকটাকে বেছে নিন। কেবল সঠিকভাবে নিজেকে সামলে রাখুন। কারণ, শেষ পর্যন্ত নিজের চেয়ে বড় অভিভাবক দুনিয়ায় আর কেউ নেই।

আশাকরি, শামিম এই লেখাটা একটা অর্থহীন লেখা হবে। আশাকরি, আপনি কখনোই সামনের পিচ্ছিল পথটাতে পা পেছলাবেন না। আপনি আমাদের সব শঙ্কা মিথ্যে প্রমাণ করে সত্যিকারের এক টেকসই তারকা হয়ে উঠবেন।

আপনার জন্য শুভকামনা, শামিম।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...