অমর এক সেঞ্চুরি

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের সূর্যটা তখনো অস্তমিত হয়নি।

নব্বইয়ের দশকের শেষভাগে তারা বড় দলগুলোর চোখে চোখ রেখে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারতো। দলে বেশ কিছু প্রতিভাবান ও কার্যকর ক্রিকেটার ছিলেন। এর মধ্যে অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার তো ক্রিকেট ইতিহাসেরই অন্যতম সেরা উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান।

এর বাইরে ছিলেন অ্যান্ডির ভাই গ্র্যান্ট ফ্লাওয়ার, বিধ্বংসী পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিথ স্ট্রিক, অ্যান্ডি ব্লিগনট, ব্যাটসম্যান মারে গুডউইন, ডেভিড হফটন, পল স্ট্র্যাং, এডো ব্র্যান্ডেস, অলরাউন্ডার নিল জনসন আর পেসার হেনরি ওলোঙ্গা।

২০০১ সালে জিম্বাবুয়ের সফরে আসে কার্ল হুপারের নেতৃতাধীন ওয়েস্ট ইন্ডিজ দল। অভিজ্ঞ খেলোয়াড়দের পাশাপাশি জিম্বাবুয়ে দলে ডাক পান ১৭ বছরের এক কিশোর; যিনি কিনা তখনো স্কুলের গণ্ডিই পেরোয়নি। নাম তাঁর হ্যামিল্টন মাসাকাদজা।

দেখতে দীর্ঘদেহী মাসাকাদজা স্কুল ক্রিকেটে রানবন্যা বইয়ে দেবার সুবাদে সরাসরি ডাক পেয়েছেন জাতীয় দলে। যদিও জাতীয় দলে তার অভিষেক হবে কিনা সেটা নিয়ে সবাই ছিলেন সন্দীহান। সবাই ভেবেছিল মূলত ড্রেসিংরুমের পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতেই মাসাকাদজাকে দলে ডাকা।

কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টেই নিজের অভিষেক ক্যাপ পেয়ে যান মাসাকাদজা। হারারে স্পোর্টস গ্রাউন্ডে টস হেরে ব্যাটিংয়ে নামে স্বাগতিকরা। যদিও ব্যাট হাতে দাঁড়াতেই পারেনি তাঁরা, নেইল ম্যাকগিল এবং কলিন স্টুয়ার্টের বিধ্বংসী বোলিংয়ের সামনে পাত্তাই পাননি জিম্বাবুয়ের ব্যাটসম্যানরা।

জিম্বাবুয়ে অলআউট হয় মাত্র ১৩১ রানে। মাসাকাদজা নিজেও আলো ছড়াতে পারেননি ক্যারিয়ারের প্রথম ইনিংসে, কলিন স্টুয়ার্টের বলে বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফেরার আগে করতে মাত্র ৯ রান।

জবাবে ব্যাট করতে নেমে শিবনারাইণ চন্দরপল এবং রামনরেশ সারওয়ানের ফিফটিতে ৩৪৭ রানের বড় সংগ্রহ পায় ক্যারিবীয়রা। প্রথম ইনিংসেই বিশাল রানে পিছিয়ে পড়ায় জিম্বাবুয়ে শিবিরে তখন ঘোর অমানিশা। ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্টেই ইনিংস হার চোখ রাঙাচ্ছে মাসাকাদজাকে।

দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট করতে নেমেও শুরুটা ভালো হয়নি জিম্বাবুয়ের। ২৭ রানের ডিওন ইব্রাহিমের উইকেট হারায় তারা। নতুন ব্যাটসম্যান হিসেবে ক্রিজে আসেন অভিষিক্ত মাসাকাদজা। মাসাকাদজার উপর তখন অনেক চাপ, একে তো অভিষেক টেস্ট।

তার উপর দল আছে বিপদে, স্কুলের সহপাঠীরা সবাই এসেছে ক্লাসমেটের ব্যাটিং দেখতে। আগের ইনিংসেই অল্প রানেই আউট হয়ে যাওয়ায় কিছুটা হতাশ এবং বিমর্ষ দেখাচ্ছে তাদের। কিন্তু মহাতারকারা বোধহয় চাপের মুখেই নিজেদের সেরাটা খেলেন।

মাসাকাদজাও ব্যতিক্রম নন, প্রথমে অ্যালিস্টার ক্যাম্পবেল এবং পরে ক্রেইগ উইশার্টকে নিয়ে জুটি গড়ে দলকে বিপদমুক্ত করেন। দারুণ সব শটে সেদিন গ্যালারি মাতিয়ে রাখছিলেন সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া মাসাকাদজা। প্রায় সাত ঘন্টা ক্রিজে থেকে ৩১৬ বলে ১২ চারে খেলেন ১১৬ রানের চোখধাঁধানো এক ইনিংস। রেওন কিংয়ের বলটা লং অফে ঠেলে দিয়ে যখন সেঞ্চুরি স্পর্শ করলেন ততক্ষণে রেকর্ডবুকে উঠে গেছে তাঁর নাম।

সেঞ্চুরির সময় তার বয়স ছিল ১৭ বছর ৩৫২ দিন, তখনো পর্যন্ত এত কম বয়সী কোনো ক্রিকেটার টেস্ট অভিষেকেই সেঞ্চুরি হাঁকাতে পারেননি। পরবর্তীতে হিথ স্ট্রিক এবং অ্যান্ডি ব্লিগনাটের ব্যাটে ভর করে ম্যাচ ড্র করে জিম্বাবুয়ে।

যদিও অভিষেকেই সর্বকনিষ্ঠ সেঞ্চুরিয়ান খেতাবটা বেশিদিন থাকেনি মাসাকাদজার নামের পাশে। তার সেঞ্চুরির মাত্র ৪১ দিন পর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে রেকর্ডটি নিজের করে নেন বাংলাদেশের মোহাম্মদ আশরাফুল। এই দুজনের পাশাপাশি কেবল শচীন টেন্ডুলকার এবং মুশতাক মোহাম্মদই কেবল ১৭ বছর বয়সে সেঞ্চুরি পেয়েছিলেন। তবে বাকিদের তুলনায় মাসাকাদজার সেঞ্চুরির মাহাত্ম্য বেশি।

সেসময় রবার্ট মুগাবের শাসনামলে কৃষ্ণাঙ্গদের জিম্বাবুয়ে জাতীয় দলে খেলার খুব বেশি ইতিহাস ছিল না। মাসাকাদজাই ছিলেন প্রথম আফ্রিকান কৃষ্ণাঙ্গ যিনি কিনা টেস্টে সেঞ্চুরি করেছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন মাত্র সপ্তম কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটার যিনি কিনা জিম্বাবুয়ের হয়ে টেস্ট খেলেছেন।

তবে ক্যারিয়ারের শুরুর টেস্টে সতীর্থদের কাছে থেকে যতটা সমর্থন পেয়েছিলেন পুরো ক্যারিয়ারজুড়ে কখনো তেমন পাননি। ক্যারিয়ারের সমস্ত সময়জুড়ে জিম্বাবুয়ের মৃতপ্রায় ক্রিকেটকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করে গেছেন। কত রান কিংবা সেঞ্চুরি দিয়ে নয়; ক্রিকেট মাসাকাদজাকে মনে রাখবে তার লড়াইয়ের জন্য, জিম্বাবুয়ের ধ্বংসস্তুপ থেকে মৃতপ্রায় ক্রিকেটকে টিকিয়ে রাখার জন্য।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link