সময়টা ১৯৯৪। গল্পের নায়ক শোয়েব আখতারের বয়স তখন ১৯। আর গল্পের স্থান লাহোর রেলস্টেশন এলাকা।
ভাই! জায়গা দিবি তোর এই গাড়িতে থাকার ? ঘোড়ার গাড়ির ভেতর ঘুমন্ত চালকের নিদ্রায় ব্যাঘাত ঘটা প্রশ্নের উত্তর আসে — ‘তুই কে ?’ প্রথম প্রশ্নকারীর উত্তর — আমি শোয়েব, রাওয়ালপিন্ডির ক্রিকেটার। পাকিস্তানের হয়ে খেলিস নাকি ? উত্তরটা ‘না’ হলেও আত্মবিশ্বাসের সাথে আবার জানিয়েও দিয়েছিল — ‘আল্লাহ চাইলে শীঘ্রই খেলবো।’
মুচকি হেসে নতুন প্রশ্ন, তাহলে তোকে জায়গা কেন দিবো? শোয়েবের এবারের উত্তরটা আগের চেয়েও জোরালো ছিল — ‘দেখে কি তারকা মনে হয়না?’ এখন মনে না হলেও, পরে আমি সেটাই হবো। আর হয়ে গেলে তোর সাথে আবারও দেখা করতে আসবো। আর, লাহোরে সেই উদ্দেশ্যেই ট্রায়াল দিতে আসা আমার।
কিশোর বয়সী শোয়েব আখতারের শেষ কথায় গলে যায় লাহোরের ঘোড়ার গাড়ি চালক আজিজ খান। এই বাংলায় ঘোড়ার গাড়িকে প্রাচীনকালে টমটম বলা হতো, আর ঘোড়ার গাড়ি চালককে উর্দুতে বলা হয় টাঙ্গিয়ালা। তাই, কাহিনী বিস্তারিত বর্ণনার সুবিধার্থে ‘টমটম’ ও তার চালককে বোঝাতে ‘টাঙ্গিওয়ালা’ শব্দটি ব্যবহার করছি লেখার বাকি অংশে।
টাঙ্গিওয়ালার ছোট্ট টমটমে থাকার জায়গা হয়ে যায় রাওয়ালপিন্ডির শোয়েব ও তার বন্ধু আজাজ আরশাদের। রাতের খাবারের খরচটাও সেদিন আজিজ খান বহন করেছিলেন। পিন্ডি হতে আগত দুই কিশোর বন্ধুর এই আশ্রয় সারাজীবনের স্মরণীয় স্মৃতি হয়ে আছে এখনও।
টাঙ্গিওয়ালা আজিজ খানের টমটমে আশ্রয় নেওয়ার আগে শোয়েবের জীবনের গল্পটা আর দশটা বালকের মতোই সাদামাটা ছিলো। জৌলুশটা ছিলো মাত্র তার মনেই। নিজের উপর থাকা অগাধ বিশ্বাসকে আপাতত জৌলুশ বলে উপমা দিলাম। সেই বিশ্বাসের পিঠে ভর করেই বন্ধু আজাজ আরশাদের পরামর্শে রাওয়ালপিন্ডি থেকে লাহোর যাত্রা দু’জনের। তাও আবার পকেটের নগন্য ২৫ রুপিতে।
বাসে চড়ার পর্যাপ্ত পয়সা ছাড়াই বাসস্ট্যান্ডে আসার পর বাসের হেল্পারের সাথে শুরু লুকোচুরি খেলা। খেলায় চূড়ান্ত জয়লাভ তাদেরই হয়। তারপর, পেছনের সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে শুরু লাহোর যাত্রা। শুরু থেকেই বাসস্ট্যান্ডে শোয়েব ও তার বন্ধু আজাজের গতিবিধি সন্দেহ হওয়ায় কোনোভাবেই যাতে বিনা টিকেটে বাসে সওয়ার হতে পারে দু’জন, সেদিকেই নজর রেখে যাচ্ছিল।
প্রতি স্টপেজে বাস থামার আগ মূহুর্তে হেল্পারের আগেই দুই বন্ধু বাসের ছাদ থেকে নেমে লুকিয়ে পড়তো পথের ধারে। এভাবেই ৭ ঘন্টার দীর্ঘ যাত্রায় কখনো বাসের ছাদে আবার কখনো ধরা পড়ে যাওয়ার শঙ্কায় বাস থেকে নেমে পথের ধারে গা ঢাকা দিয়ে পৌঁছালো স্বপ্নের শহর লাহোরে।
স্বপ্নের শহরে যে যাত্রাকে তুলনা করা চলে স্বপ্নের যাত্রার সাথে। কেননা, এ যাত্রাই তাকে এগিয়ে নিয়ে যায়, পৌঁছে দেয় স্বপ্নের দুয়ারে কড়া নাড়ার কাঙ্খিত মুহূর্তে।
সেই কিশোর বয়সে দূরন্ত শোয়েব লেখাপড়ায়ও বেশ তুখোড়। পরিবার প্রকৌশলী বানাতে চাইলেও ক্রিকেটেই সুখের দেখা মিলছিল। তাই উদ্যমী মন থামাতে পারেনি পরিবারের অগোচরে রুগ্ন পকেটে লাহোর যাত্রা। তবে, বিপত্তি বাঁধে লাহোর পৌঁছে থাকার জায়গার সংকট নিয়ে। ২৫ রুপি দিয়ে হোটেলে থাকলে রাতের খাবার ও সকালের নাস্তা কপালে জুটবে না। এদিকে, সকালে ট্রায়াল তাই দুবেলাই খাবার গ্রহণ আবশ্যিক। খালি পেটে ট্রায়ালে বোলিং করা অসম্ভব, এতে ভেস্তে যেতে পারে ট্রায়ালে উত্তীর্ণ হয়ে একদিন পাকিস্তান জাতীয় দলের জার্সিতে মাঠে নামার স্বপ্ন।
তবে, সেখানেও হার মানেনি শোয়েব। বাচনভঙ্গি ও মন জয় করে নেওয়ার দক্ষতায় জুটিয়ে নেন টাঙ্গিওয়ালা আজিজ খানের টমটমে মাথার গুঁজার ঠাঁই। রাতের থাকা ও খাওয়ার ভার নিয়ে নেন আজিজ খান। পূর্ণ মেহমানদারি যাকে বলে। খুব সকালে দুজনকে ঘুম থেকে ডেকে তোলেন আজিজ। সকালের নাস্তাও সেদিন আজিজের মেহমানদারিতেই হয়েছিল। মডেল টাউনের গ্রাউন্ডে ট্রায়াল। আগের রাতেই শোয়েবের চেহারায় সম্ভাবনা ধরা দেয় আজিজের চোখে।
তাই, মডেল টাউন গ্রাউন্ডের পথ ধরে টমটম যতটুকু যাওয়ার অনুমতি আছে ততটুকু পথ এগিয়ে দিয়েছিল। টমটম থেকে নেমে শোয়েব নিজের ওয়াদা আজিজকে মনে করিয়ে দিয়ে বলে — ‘আমি যখন পাকিস্তানের হয়ে খেলবো, তোর সাথে দেখা করতে অবশ্যই আসবো।’ আর যদি কখনও খবর আসে কোনো খেলোয়াড় তোকে খুঁজছে, মনে করবি সেটা আমি। নামটা মনে রাখিস – শোয়েব আখতার!
পায়ে হেঁটে ও দৌঁড়ে বাকি পথ পাড়ি দিতে দুই ঘন্টা সময় লেগেছিল।
ট্রায়াল গ্রাউন্ডে পৌঁছে কয়েকশো কিশোরের পেছনে ক্লান্ত শরীরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা। সেদিন ট্রায়ালের দায়িত্বাভার পাকিস্তান ক্রিকেট গ্রেট জহির আব্বাসের কাঁধে পড়ে। শোয়েবের দ্রুতগতির অপ্রতিরোধ্য বোলিং নজরের বাইরে যায়নি জহির আব্বাসের। সেখান থেকেই প্রথম শোয়েব আখতার থেকে রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেস বনে যাওয়ার সূত্রপাত।
অল্প সময়ের ব্যবধানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জগতেও নিজেকে পরিচিত করে ফেলেন। ৯০’র দশকের প্রতাপশালী পাকিস্তান দলে নিয়ে ধারণা তো সবারই আছে। আগ্রাসী ও শৈল্পিক সিমার তৈরির কারখানা ও মারকুটে ব্যাটসম্যানের ভাণ্ডারে ভরপুর পাকিস্তান দলে শোয়েবের পদার্পণ ১৯৯৭ সালে।
ওয়াসিম আকরাম, ওয়াকার ইউনুস, আজহার মাহমুদের সাথে নতুন নাম শোয়েব আখতার; যোগ করে পেস আক্রমণে বাড়তি মাত্রা। গতির ঝড় তুলে চমকে দেন বাইশ গজে, আর তাতেই হিড়িক লেগে যায় আখতারকে ঘিরে ক্রিকেট বোদ্ধাদের আগ্রহ। ক্রমেই বিশ্বমন্ডলেও ‘রাওয়ালপিণ্ডি এক্সপ্রেস’ নামের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৯৯ বিশ্বকাপে দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন। দল ফাইনাল জিততে ব্যর্থ। তাতে কি? তরুণ শোয়েবের সামনে খোলা ছিলো আরও কয়েক বিশ্বকাপে মাঠে নামার সুযোগ, উন্মুক্ত ছিলো বিশ্বকাপ জয়ের সম্ভাবনা ও নিজেকে পরিপূর্ণভাবে মেলে ধরার সুযোগ। লোকে তাকে নিয়ে নিয়মিত এসব ভাবলেও তার মন আটকে ছিলো লাহোরের টাঙ্গিওয়ালা আজিজ খানকে দেওয়া ওয়াদা পূরণে। জাতীয় দলের ব্যস্ততায় সময়ই হয়ে উঠছিল না।
ওয়াদা পূরণ না করতে পারায় নিয়মিত ছটফট করতো শোয়েব। আজিজ খানের অবদানের প্রতি ছিল তার অসীম কৃতজ্ঞতা। তাই ওয়াদা পূরণের আশাও বন্ধ হয়নি। ১৯৯৯ সালেই ন্যাশন্যাল ক্যাম্পে দলের সবার যাত্রা লাহোরে। এমন সংবাদে অন্য সবার জন্য পেশাগত সফর হলেও শোয়েবের জন্য ছিল ওয়াদা পূরণের সফর। এটাকেই মোক্ষম সুযোগ ধরে নিলেন, তাই কাজে লাগাতেই হবে এই সুযোগ।
লাহোর পৌঁছে এদদিন সময় করে নিজের বেশভূষা পাল্টে লাহোর রেলস্টেশনে গিয়ে সন্ধান লাগালেন ছয় বছর আগের সেই পুরোনো বন্ধুকে। কয়েকঘন্টা সময় লেগে যায় তাকে খুঁজে বের করতে। এদিনও ঘুমন্ত অবস্থায় তার সন্ধান মেলে। আজিজ খান কিছু বলার আগেই, পাকিস্তান ক্রিকেটার বলে উঠলো — ‘আমি শোয়েব’। খুশিতে বাচ্চার মতো লাফিয়ে তার কোলে উঠে পড়ে টাঙ্গিওয়ালা আজিজ। আর উচ্চস্বরে বলতে থাকে — ‘বন্ধু তুই শোয়েব আখতার আমার এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না।’
আজিজ খানের চিৎকারে শোয়েব আখতারের নাম শুনে আশেপাশের মানুষ ভীড় জমাতে শুরু করে। সেদিনও নিজ খরচায় রুটি-পরোটার আপ্যায়ন করায় শোয়েবকে। হোটেলে একসাথে খাবার খাওয়ার সময় আজিজ খান বলে উঠে — ‘দেখ! তোকে দেখার জন্য কত মানুষ, এরা সবাই তোকে রুটি-পরোটা খাইয়ে আপ্যায়ন করতে চায়, তোকে তাদের ঘরে নিয়ে যেতে চায়।’ ছয় বছর আগে আমাকে তুই জায়গা দেওয়ায় আজ আমি পাকিস্তান দলে। আমিও তাই তোর কাছেই ফিরে আসলাম। সবাই হয়তো আমাকে চায়, আর আমি চাই তোর সাক্ষাতের। শোয়েবের এমন জবাবে তাৎক্ষণিক আজিজ আবারও তার সাথে থাকার অনুরোধ করলে শোয়েবও রাজি হয়ে যায়।
একরাতের সাক্ষাতে জন্ম নেওয়া কয়েকঘন্টার বন্ধুত্বের আন্তরিকতা ছয় বছর পর দুজনকে আবারও একসাথে রাত কাটানোর সুযোগ করে দেয় টমটমে। পরদিন সকালে শোয়েবের পথ আবারও এগিয়ে দেয় আজিজ খান। ১৯৯৪ সালে মডেল টাউন গ্রাউন্ডের পথে যতটুকু পথ এগিয়ে দিয়েছিল, ঠিক ততটুকুই আবারও শোয়েবকে এগিয়ে দেয় আজিজ খান। যাতে ফিরে আসে ছয় বছর আগের সেই শূণ্য পকেটে বন্ধুত্বের হাত বাড়ানো অচেনা আজিজ খানের সাথে কৈশোরকালীন স্মৃতি।
প্রত্যেক মানুষের সফলতার গল্পে একজন সহায়তাকারী বা সমর্থন যোগানো মানুষের অস্তিত্ব জুড়ে থাকে। নিজ এলাকার বন্ধু আজাজ আরশাদের ভূমিকাও ছাপিয়ে উপরে উঠে যায় টাঙ্গিওয়ালা বন্ধু আজিজ খানের ভূমিকা। জীবনে কখনও কখনও অচেনা বন্ধুও এগিয়ে আসে। তাই হয়তো এই বন্ধুত্ব সম্পর্কটা এতোটাই মধুর।
টাঙ্গিওয়ালার অবদান শোয়েবের ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরুর আগে দারুণভাবে কাজে দেয়। একারণেই শোয়েব জাতীয় দলে প্রবেশের দুই বছর পর কাড়িকাড়ি টাকা বানিয়েও ভুলে যায়নি সেই উপকারের কথা। কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছে ওয়াদা পূরণ করে।
আরও গভীরভাবে বললে সে রাতে টাঙ্গিওয়ালার আশ্রয় শোয়েবের জন্য ছিলো বিরাট ঋণ। ছয় বছর পর ওয়াদা পূরণ করার উদ্দেশ্যে সাক্ষাত করলেও বোধহয় সে ঋণ শোধ করতে পারেনি শোয়েব আখতার। এখনও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে শোয়েব টাঙ্গিওয়ালা বন্ধুর নাম।
দ্বিতীয় সাক্ষাতের বছর দুয়েক পরেই টাঙ্গিওয়ালা আজিজ খান পরপারে পাড়ি জমান। যে সংবাদ নাড়িয়ে দেয় রাওয়ালপিন্ডি এক্সপ্রেসকে। মনে করিয়ে দেয় উপকারের কথা, যা হয়ে আছে ঋণাকারে। যে ঋণ শোধ করা সম্ভব ছিলোনা কখনোই।