দ্য রবিন জ্যাকম্যান অ্যাফেয়ার

জ্যাকম্যানের এক বন্ধুর মেয়ে মানুষের গলার স্বরের পরিবর্তন বিষয়ক একটা কোর্স করেছিল। পরীক্ষা করার জন্য সে জ্যাকম্যানের কণ্ঠকে বেছে নিয়েছিল। সে হঠাৎ খেয়াল করে যে, ধারাভাষ্য দেয়ার সময় তার কণ্ঠ কিছুটা অস্বাভাবিক লাগছে। কিছু পরীক্ষা করানোর পর জ্যাকম্যানের ভোকাল কর্ডে ক্যান্সার ধরা পড়ে। কিন্তু বরাবরের মতই এই যুদ্ধটাও বীরদর্পে জিতে ফিরে আসেন তিনি।

১৯৮০ সালের আগস্টে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে শতবর্ষী টেস্টের জন্য ঘোষিত ইংল্যান্ড দলে জায়গা পেয়েছেন ৩৫ বছর বয়সী রবিন জ্যাকম্যান। সারের এই ফাস্ট বোলার তো মহাখুশি। ছয় বছর আগে ওয়ানডে অভিষেক হলেও ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে টেস্টটা এখনও খেলা হয়নি তার বয়সও হয়ে গেছে, ইংল্যান্ডের হয়ে টেস্ট খেলার আশাও তাই ফিকে হয়ে যাচ্ছিল। এমন সময়ে দলে ডাক পাওয়াটা কতটা আনন্দদায়ক হবে তা কিছুটা অনুমান করা যায়।

ফর্মের তুঙ্গে আছেন জ্যাকম্যান, সারের হয়ে সে মৌসুমে নিয়েছেন সর্বোচ্চ উইকেট। আছেন টেস্ট অভিষেকের দ্বারপ্রান্তে ৷ একাদশে থাকবেন কিনা ভাবতে ভাবতে হোটেলে ঢোকা মাত্র যেন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসলেন।

হোটেলের অভ্যর্থনাকারী তাকে বললেন, ‘আচ্ছা আপনিই তাহলে মিস্টার জ্যাকম্যান, হোটেলে আপনার দু’দিন থাকার বন্দোবস্ত হয়েছে।’ বেচারা জ্যাকম্যান বুঝতে পারলেন যে, তাকে আসলে স্ট্যান্ডবাই হিসেবে নেয়া হয়েছে।

এরপর ক্যারিবিয়ান সফরের প্রাথমিক দলে জায়গা হয়নি তাঁর। কিন্তু সহ-অধিনায়ক বব উইলিসের চোটের সুবাদে আরেকবার সুযোগ মিলে গেল জ্যাকম্যানের। উড়ে গেলেন গায়ানার জর্জটাউনে। সন্ধ্যায় সেখানে পৌঁছে দেখতে পেলেন গায়ানা ক্রিকেট বোর্ড এক পার্টির আয়োজন করেছে। ব্রিটিশ কমেডিয়ান প্যাট্রিক কার্গিলের ভাগ্নে জ্যাকম্যান বেশ পার্টি-প্রিয় লোক। এ তো সোনায় সোহাগা। পার্টির মধ্যেই বলে উঠলেন, ‘এবার আর কোনো কিছুই আমাকে টেস্ট খেলা থেকে আটকাতে পারবে না।’

জ্যাকম্যান কিন্তু টেস্টটা খেলতে পারেননি। এমন কারণে খেলতে পারেননি যা সচরাচর দেখা যায় না।

ওয়ানডে দলে অবশ্য নেই জ্যাকম্যান৷ বার্বিসে ওয়ানডে ম্যাচের আগে কোনো একজন স্থানীয় ধারাভাষ্যকার রবিন জ্যাকম্যানের সাথে দক্ষিণ আফ্রিকার সম্পর্কের কথা উল্লেখ করলেন।

প্রায় বারো বছর আগে দক্ষিণ আফ্রিকায় যান জ্যাকম্যান। ইংল্যান্ডে শীত মৌসুমে কোনো খেলা না থাকায় কিছু বাড়তি আয়ের জন্য সেখানে গিয়ে কোচিংয়ের চাকরি নেন ও সেখানকার কারি কাপে খেলা শুরু করেন। তারপর থেকে প্রতিবছর শীতে দক্ষিণ আফ্রিকায় চলে যেতেন জ্যাকম্যান। এক সুন্দরী দক্ষিণ আফ্রিকান তরুণীর প্রেমে পড়ে তাকে বিয়েও করেন জ্যাকম্যান।

বারো বছর পরের যে সময়ের কথা বলছি, তখনও জাতিবিদ্বেষ বা ‘apartheid’-এর জন্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে নিষিদ্ধ দক্ষিণ আফ্রিকা। গায়ানা বোর্ড এ ব্যাপারে ছিল অত্যন্ত কঠোর।

যাহোক, বার্বিসের সেই ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের হারের পর হোটেলে ফেরেন জ্যাকম্যান। কিছুক্ষণ পরই উর্দি পরিহিত এক লোক এসে জ্যাকম্যানের হোটেল রুমের খোঁজ করেন এবং তার হাতে একটি নোটিশ ধরিয়ে দেন।

জ্যাকম্যানের ঘুণাক্ষরেও ধারণা ছিল না কী হতে যাচ্ছে ৷ হাতে নিয়ে দেখলেন যে, দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে তাঁর সম্পর্কের জন্য গায়ানাতে তার দু’সপ্তাহের ভিসা বাতিল করা হয়েছে।

গায়ানার জর্জটাউনে সেই টেস্টটা বিস্ময়করভাবে বাতিল করা হয়৷ দু’দেশের সাংবাদিকদের মধ্যে বিস্তর বাকবিতণ্ডা হয়, ম্যাচটা ‘বাতিল’ নাকি ‘পরিত্যক্ত’ হয়েছে এই নিয়ে। কিন্তু, একজন ক্রিকেটার খেলবে বলে একটা টেস্ট ম্যাচ বাতিল হয়ে যাওয়ার নজিরবিহীন ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

সৌভাগ্যবশত বার্বাডোজ সরকার গায়ানা সরকারকে অনুসরণ করেনি। বার্বাডোজের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচে ৬৮ রানে চার উইকেট নিয়ে দারুণ ফর্মের ইঙ্গিত দেন জ্যাকম্যান।

অবশেষে বার্বাডোজের ব্রিজটাউনে ইংল্যান্ডের জার্সি গায়ে টেস্ট অভিষেক হয় জ্যাকম্যানের। ইংল্যান্ড হেরে গেলেও জ্যাকম্যান ৩/৬৫ ও ২/৭৬ বোলিং বিশ্লেষণ দিয়ে নজর কেড়েছিলেন।

ছোট ক্যারিয়ারে চার টেস্টে ১৪ উইকেট নিয়েছিলেন জ্যাকম্যান। সারের হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ২২.৮ গড়ে ১৪০২ উইকেট ও লিস্ট এ ক্রিকেটে ২১.২ গড়ে ৪৩৯ উইকেট নিয়েছেন এই ফাস্ট বোলার।

রবিন জ্যাকম্যানের জন্ম হয়েছিল ভারতের (ব্রিটিশ ইন্ডিয়া) শিমলায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তার বাবা সেকেন্ড গুরখা রাইফেলসের মেজর ছিলেন৷ গুলিবিদ্ধ হয়ে যুদ্ধের এক পা হারিয়েছিলেন তিনি। জ্যাকম্যানরা এরপর সারে চলে যান।

ক্যারিয়ার শেষে তার তৃতীয় দেশ দক্ষিণ আফ্রিকায় পাড়ি জমান জ্যাকম্যান৷ সুপার স্পোর্টের হয়ে ধারাভাষ্য দিয়েছেন দীর্ঘ সময়৷

জ্যাকম্যানের এক বন্ধুর মেয়ে মানুষের গলার স্বরের পরিবর্তন বিষয়ক একটা কোর্স করেছিল। পরীক্ষা করার জন্যে সে জ্যাকম্যানের কণ্ঠকে বেছে নিয়েছিল। সে হঠাৎ খেয়াল করে যে, ধারাভাষ্য দেয়ার সময় তার কণ্ঠ কিছুটা অস্বাভাবিক লাগছে।

কিছু পরীক্ষা করানোর পর জ্যাকম্যানের ভোকাল কর্ডে ক্যান্সার ধরা পড়ে। কিন্তু বরাবরের মতই এই যুদ্ধটাও বীরদর্পে জিতে ফিরে আসেন তিনি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...