১৮ জানুয়ারি, ১৯৯৮। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে স্বাধীনতা কাপের ফাইনালে ভারত-পাকিস্তানের ফাইনালে তখন টান টান উত্তেজনা। ভারতের ডাগ আউটে শচীন-সৌরভদের কপালে চিন্তার রেখা। শেষ দুই বলে প্রয়োজন তিন রান। গ্যালারি ভর্তি দশকদের চাপা উৎকণ্ঠা।
স্ট্রাইকে তরুণ হৃষিকেশ কানিতকার, বল হাতে সাকলাইন মুশতাক। লেগ স্টাম্পের উপর বল করলেন সাকলাইন! মিড উইকেটের উপর দিয়ে বাউন্ডারি মেরে শ্বাসরুদ্ধকর এক জয় তুলে নেয় ভারত। তিন উইকেটের দুর্দান্ত জয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে শিরোপা জয় করে ভারত। ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে তখন উন্মত্ত-উৎফুল্ল দর্শক।
তখনো বাংলাদেশ দল টেস্ট স্ট্যাটাস লাভ করেনি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের ২৫ বছর বা স্বাধীনতার সিলভার জুবিলি উপলক্ষ্যে ভারত ও পাকিস্তানকে নিয়ে তিন দলের টুর্নামেন্ট আয়োজন করে বাংলাদেশ। রবিন রাউন্ড পদ্ধতিতে গ্রুপ পর্বের পর টপ দুই দলের মধ্যে হবে তিন ম্যাচের ফাইনাল!
নিজেদের দুই খেলায় পরাজয় নিয়ে গ্রুপ পর্বেই বাদ পড়ে স্বাগতিক বাংলাদেশ দল। গ্রুপ পর্বের একবারের দেখায় পাকিস্তানের বিপক্ষে ১৮ রানের জয় পায় ভারত। এরপর তিন ম্যাচ ফাইনালের প্রথম ম্যাচে শচীন টেন্ডুলকারের অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ৮ উইকেটের বড় জয় নিয়ে ১-০ তে এগিয়ে যায় ভারত। ওই ম্যাচে ওয়ানডেতে সবচেয়ে কম বয়সে ৬ হাজার রানের রেকর্ডও গড়েন শচীন।
টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় ফাইনালে মোহাম্মদ হাসনাইন ও সাইদ আনোয়ারের দাপুটে পারফরম্যান্সে ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে ৬ উইকেটের জয় তুলে নেয় পাকিস্তান। এই জয়ে তিন ম্যাচের ফাইনালে ১-১ সমতা আনে পাকিস্তান। শেষ ফাইনালে তাই চরম উত্তেজনা। ভারত-পাকিস্তান খেলা মানেই খেলার মাঝেও অন্য এক লড়াই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের ক্রিকেটপ্রেমীদের জন্য উত্তেজনার এক ম্যাচ। তার উপর টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচ! সবার মাঝেই চরম উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনা।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে টসে হেরে প্রথমে ব্যাটিংয়ে নামে পাকিস্তান। ঘন কুয়াশায় আলোক স্বল্পতার কারণে কিছুক্ষণ দেরীতে খেলা শুরু হলে ২ ওভার কমিয়ে ৪৮ ওভারে নির্ধারণ করা হয়। কানায় কানায় পূর্ণ বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম। তিল ধারণের জায়গা অবদি নেই।
প্রথমে ব্যাট করতে নেমে ওপেনিং জুটিতে ৩০ রান সংগ্রহ করে পাকিস্তান। এরপর হারভিন্দর সিংয়ের দুই উইকেট শিকারে বিদায় নেন শহীদ আফ্রিদি ও আমির সোহেল। ব্যক্তিগত ১৮ রানে আফ্রিদি ও ১৪ রানে আমির সোহেল ফিরলে দলীয় সংগ্রহ দাঁড়ায় ২ উইকেটে ৬৬ রান। একপ্রান্তে তখনো ঠায় দাঁড়িয়ে ওপেনার সাঈদ আনোয়ার। তৃতীয় উইকেটে ইজাজ আহমেদকে নিয়ে জুটি গড়েন তিনি। বাকি পথটা নিজেদের মতো করেই সাজান দু’জনে!
ভারতীয় বোলারদের উপর চড়াও হয়ে কিছুটা দ্রুত গতিতে রান তুলতে থাকেন দু’জনে। দুই প্রান্তে অনবদ্য ব্যাটিং করে দু’জনেই তুলে নেন ফিফটি। ভারতের অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন সাত বোলার ব্যবহার করেও থামাতে পারেননি এই জুটিকে! সাইদ-ইজাজদের সামনে ভারতীয় বোলাররা একপ্রকার অসহায় হয়ে পড়েন। এরপর দু’জনে মিলে গড়েন সেঞ্চুরির জুটি! অসাধারণ ব্যাটিং নৈপুণ্যে দেখিয়ে দু’জনেই এগোতে থাকেন সেঞ্চুরির দিকে।
হারভিন্দর সিং, জাভাগাল শ্রীনাথরা সেদিন বল হাতে পাত্তাই পাচ্ছিলেননা এই জুটির কাছে। সচল রানের চাকা, অপরদিকে দুই সেট ব্যাটসম্যান। সব মিলিয়ে ভারতীয় অধিনায়ক যেনো নিরুপায়! এরই মধ্যে দু’জনের দেড়শো রানের জুটির পর দুর্দান্ত ব্যাটিং করে দু’জনই তুলে নেন সেঞ্চুরি!
এই দু’জনের ব্যাটে বেশ পাহাড়সম একটা সংগ্রহ পাকিস্তান দাড় করাবে সেটা তখনি আঁচ করা যাচ্ছিলো। তবে শেষ পর্যন্ত এই জুটি ভাঙতে সক্ষম হন সেই ম্যাচে ভারতের একমাত্র সফল বোলার হারভিন্দর সিং। ১৩২ বলে ১৪ চার আর ২ ছক্কায় ১৪০ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন বিদায় নেন সাইদ আনোয়ার।
দলের রান তখন তিনশোর দ্বারপ্রান্তে! ইনিংসের এক ওভার বাকি থাকতে জাভাগাল শ্রীনাথের বলে বিদায় নেন ইজাজ আহমেদও। ১১২ বলে ৮ চার ও ১ ছক্কায় অসাধারণ এক ইনিংস উপহার দেন তিনি। শেষদিকে আজহার মেহমুদের ৬ বলে ১০ রানে নির্ধারিত ৪৮ ওভারে ৫ উইকেটে ৩১৪ রান সংগ্রহ করে পাকিস্তান।
সাঈদ আনোয়ার ও ইজাজ আহমেদের জোড়া সেঞ্চুরিতে বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় পাকিস্তান। ভারতের পক্ষে ১০ ওভারে ৭৪ রানে হারভিন্দর ৩ এবং ৬১ রানে শ্রীনাথ নেন ১ উইকেট। ৩১৫ রানের পাহাড়সম লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে হলে গড়তে হবে বিশ্ব রেকর্ড! আকিব জাভেদ, সাকলাইন মুশতাক, শহীদ আফ্রিদিদের সামনে এই লক্ষ্য তাড়া করাটা যেনো তখন অসম্ভব কিছু ছিলো। তবে, সব সমীকরণের ঊর্ধ্বে উঠে সৌরভ গাঙ্গুলি- শচীনরা সেদিন নেমেছিলো আরেক কাব্য রচনা করতে।
বিশাল লক্ষ্যমাত্রা তাড়া করতে নেমে ওপেনিং জুটিতে সৌরভ-শচীনদের তাণ্ডবে ৮ ওভারেই দলীয় রান ৭০ এর কোটায়! শচীন টেন্ডুলকারের ২৬ বলে ৪১ রানের ঝড়ো ইনিংস থামান শহীদ আফ্রিদি। দলীয় ৭১ রানে শচীন ফিরলে জুটি বাধেন সৌরভ ও রবিন সিং। সাঈদ আনোয়ার ও ইজাজ আহমেদের জুটি অনুসরণ করে সৌরভ-রবিনরা হাঁটতে থাকেন একই পথে।
পাকিস্তানি বোলারদের পাত্তা না দিয়ে রানের চাকা সচল রাখেন দু’জনেই। একপ্রান্তে সৌরভ তুলে নেন ফিফটি। আকিব, মুশতাকরাও ছিলেন তাদের সামনে নিরুপায়! এর মাঝেই ইনজুরিতে পড়েন আফ্রিদি! দু’জনের ব্যাটে তখন জয়ের স্বপ্ন দেখছিলো ভারত। দু’জনে মিলে জুড়ে দেন শতরানের অনবদ্য এক জুটি! পাকিস্তানি অধিনায়ক রশিদ লতিফের কোনো অস্ত্রই যেন থামাতে ব্যর্থ হচ্ছিলো তাদের।
এরপর একপ্রান্তে রবিনের ফিফটি আর আরেক প্রান্তে সৌরভের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি! ম্যাচে তখন ভারতের আধিপত্য। দু’জনের জুটি তখন দেড়শো পার। ধীরে ধীরে রবিনও পৌঁছে যাচ্ছিলেন কাঙ্খিত সেঞ্চুরির লক্ষ্যে। কিন্তু সেঞ্চুরি থেকে খানিকটা দূরে ব্যক্তিগত ৮২ রানে মোহাম্মদ হুসাইনের বলে কাটা পড়েন রবিন! সেঞ্চুরির আক্ষেপ নিয়ে ফেরত গেলেও ম্যাচে জয়ের ভীত দেন তিনি। ২৫০ রানে দ্বিতীয় উইকেট হারায় ভারত। শেষ ৫৯ বলে দরকার তখন মাত্র ৬৫ রান, হাতে ৮ উইকেট। রেকর্ড জয়ের দিকেই এগোচ্ছিলো ভারত।
এরপর তৃতীয় উইকেটে ১৮ রানের জুটির পথে আউট অধিনায়ক মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন! পরের ওভারেই আউট সেঞ্চুরি করা সৌরভ গাঙ্গুলিও। দলীয় ২৭৪ রানে চতুর্থ উইকেট হারায় ভারত। ১৩৮ বলে ১ ছয় ও ১১ চারে ১২৪ রান করেন সৌরভ। আরেক ওভার না যেতেই আউট নভজ্যোৎ সিং সিধু। টানা তিন ওভারে তিন উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে ভারত। ২৮১ রানে তখন ৫ উইকেট! ৪০ বলে ভারতের দরকার ৩৪ রান, হাতে ৫ উইকেট। তখনো বেশ সহজ সমীকরণই ছিলো। এরপর দুই ওভারের মাথায় আউট অজয় জাদেজাও!
শেষ ৩ ওভারে দরকার ছিলো ২৫ রান। সাকলাইন মুশতাকের টাইট বোলিংয়ে রানের চাকা অনেকটাই ধীর হয়ে যায়। ৪৬ তম ওভারে সাকলাইন মুশতাকের প্রথম বলেই চার মারেন অজয় জাদেজা! ওই ওভারের চতুর্থ বলে বোল্ড হয়ে ফেরত যান জাদেজা। ২৯৬ রানে ষষ্ঠ উইকেট হারায় ভারত। ওই ওভারে সাকলাইন দেন মাত্র ৭ রান! শেষ ২ ওভারে দরকার ১৮ রান।
আকিব জাভেদের করা ৪৭ তম ওভারের প্রথম বলেই চার মারেন নয়ন মঙ্গিয়া! পরের চার বলে নেন আরো ৫ রান। সাত বলে তখন দরকার মাত্র ৯ রানের। ওভারের শেষ বলে আকিব জাবেদের ইয়োর্কার মিস করেন স্ট্রাইকে থাকা কানিতকার। কিন্তু রান নেওয়ার জন্য দৌড় দেন নয়ন মোঙ্গিয়া। উইকেটের পেছনে বল ধরেই থ্রোয়ে উইকেট ভেঙে দেন রশিদ লতিফ। ব্যাস, অল্পের জন্য রান আউটের শিকার করে ফেরত যান মোঙ্গিয়া।
শেষ ওভার। ক্রিজে হৃষিকেশ কানিতকার এবং নতুন ব্যাটসম্যান জাভাগাল শ্রীনাথ। প্রয়োজন ৯ রান, হাতে তিন উইকেট। বোলিংয়ে আসলেন সাকলাইন মুশতাক। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে পিন পতন নীরবতা! সবার মাঝে একটা চাপা উৎকন্ঠা। প্রথম বলে সিঙ্গেল নিয়ে প্রান্ত বদল করেন কানিতকার। পরের বলেই উড়িয়ে মারতে গিয়ে গ্যাপে পড়ায় ২ রান নেন শ্রীনাথ। চার বলে দরকার ৬ রান।
পরের বলেই আবারো উড়িয়ে মারেন শ্রীনাথ! সৌভাগ্যক্রমে এ যাত্রায়ও বেঁচে যান তিনি। তিন প্রান্ত থেকে তিন ফিল্ডার দৌড়ে আসলেও মাঝামাঝি জায়গায় বল পড়ে। সহজেই দুই রান নিলেন শ্রীনাথ। টানা দুই বলে চার রান নেওয়ায় সমীকরণ বেশ সহজ হয়ে যায় ভারতের। পরের বলেই কাট করেই দৌড়ে সিঙ্গেল নিলেন তিনি।
শেষ ২ বলে দরকার ৩ রান! লেগ স্টাম্পের উপর বল করলেন মুশতাক। স্ট্রাইকে থাকা হৃষিকেশ কানিতকার মিড উইকেটের উপর দিয়ে দুর্দান্ত এক বাউন্ডারি মেরে দলকে জয়ের বন্দরে পৌঁছে দেন। এক বল বাকি থাকতে ৩ উইকেটের শ্বাসরুদ্ধকর জয় নিয়ে মাঠ ছাড়ে ভারত।
একই সাথে সেই সময়ে রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড গড়ে মোহাম্মদ আজহারউদ্দীনের দল। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে হাজার হাজার দর্শকের সামনে এক ঐতিহাসিক কাব্য রচনা করে ভারত।