নব্বইয়ের দশকে যে ঢাকাতে আমি বেড়ে ওঠি সেটা ছিল রাজনীতি ও খেলাধুলা দ্বারা বিভক্ত। আমার বয়সী ছেলেপেলেরা রাজনীতিতে খুব কমই আগ্রহী ছিল। যে দলই হরতালের ডাক দিত তাদের প্রতি আমাদের সমর্থন থাকত। কারণ হরতাল মানেই বিদ্যালয় বন্ধ ও রাস্তাঘাট শূণ্য।
খেলাধুলার জন্য সমর্থনটি মূলত আবাহনী-মোহামেডান প্রতিদ্বন্দ্বিতার পঙক্তিতে বিভক্ত ছিল, যা সত্তরের দশকের মাঝামাঝি থেকে ফুটবলে শুরু হয়, আশির দশকের শেষেরদিকে ছড়িয়ে পড়ে এবং নব্বইয়ের দশকে ঢাকা প্রিমিয়ার লিগের মাধ্যমে ক্রিকেটেও শুরু হয়। তবে যে ক্রিকেট প্রতিদ্বন্দ্বিতা সম্পর্কে সবাই কথা বলতে পছন্দ করত তা হলো পাক-ভারত দ্বৈরথ। এটা ছিল নাড়ি স্পন্দন বাড়িয়ে দেয়া ও রক্ত গরম করে দেয়ার মত এক দ্বৈরথ।
আজকের দিনে এসে আপনি অবাক হতে পারেন এই ভেবে যে বাংলাদেশিরা কেন ভারত-পাকিস্তান ম্যাচকে ঘিরে উচ্ছ্বসিত হবে! কিন্তু যখন শীর্ষস্তরে খেলার জন্য বাংলাদেশের কোন ক্রিকেট দল ছিল না তখন ক্রিকেট ভক্তদের মাঝে অন্যান্য আন্তর্জাতিক দলগুলোর মধ্যে একটিকে সমর্থনের জন্য বেছে নেয়ার ঝোঁক ছিল।
১৯৭৯ থেকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত প্রতি চার বছর অন্তর আইসিসি ট্রফিতে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ এবং ফেরে খালি হাতে। তারপর ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়ের মাধ্যমে ১৯৯৯ বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ। এ জয়ের আগ পর্যন্ত এদেশে ক্রিকেটের প্রতি মানুষের আগ্রহ তুঙ্গে থাকত কেবল আবাহনী-মোহামেডানের ‘ঢাকা ডার্বি’ ও ভারত-পাকিস্তান লড়াইয়ের সময়।
যখন ভারত-পাকিস্তান লড়াইটা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হতো উত্তেজনার পারদটাও বেশ চড়তো।
সেই ম্যাচগুলোর বেশিরভাগই একতরফা হতো। তবে আমাদের ১৯৯৮ ইন্ডিপেন্ডেন্স কাপ ফাইনালও ছিল যেটা পরিচিত ঋষিকেশ কানিতকর ম্যাচ হিসেবে। কারণ শেষ বলে তাঁর বাউন্ডারিতেই হাই স্কোরিং সেই ম্যাচের নাটকীয় সমাপ্তি ঘটেছিল।
সেই সব ম্যাচের কোন টিকেটই অবিক্রিত থাকত না। বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামের পাশে পুরান ঢাকায় যারা বসবাস করতেন তারা ম্যাচের দিন ভোরবেলা থেকেই স্টেডিয়ামে এসে সারি বেঁধে দাঁড়াতেন এবং জয়ী দলের সমর্থকরা গভীর রাত পর্যন্ত উদযাপন করতেন।
কেবল স্টেডিয়ামের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে নয়, পুরান ঢাকা ছিল সমর্থন ঘাঁটির এক উজ্জ্বল কেন্দ্র। এ অঞ্চলের ইতিহাস এবং সেখানে বসবাসকারী বাঙালি ও উর্দুভাষী জনসংখ্যার সাথে এর সম্পর্ক ছিল। পুরনো সম্পর্কের জন্য মানুষজনের একটি আকর্ষণ কাজ করত।
উর্দুভাষীরা পাকিস্তানকে সমর্থন জোগাতো এবং বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর একটি সংমিশ্রণ ভারতকে সমর্থন করত। তবে পাকিস্তান কিংবা ভারতের সমর্থক হওয়ার পেছনে সর্বদা পারিবারিক কোন সংযোগের প্রয়োজন পড়ত না। ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর এবং শান্তিনগরের মত রাজধানীর অন্যান্য অংশেও এই দ্বৈরথের স্বীকৃতি ছিল।
কিন্তু, কোনকিছুই পুরান ঢাকার মজাটাকে পেছনে ফেলতে পারেনা যেখানে খেলা চলাকালীন সময় ছোট ছোট গলি সর্বদা গুঞ্জনপূর্ণ থাকত এবং প্রতিবার উইকেট পড়লে বা ছয় মারা হলে আওয়াজে ফেটে পড়ত। নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে সমর্থকরা বিরিয়ানি, মিষ্টি এবং আতশবাজির সাথে জয় উদযাপন করার জন্যও পরিচিত ছিল।
অস্বীকার করার সুযোগ নেই যে এই তিনটি দেশের ইতিহাস ওই ম্যাচগুলাতে একটা ভূমিকা পালন করত। পাকিস্তানের সাথে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ। যদিও বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের যুদ্ধ ও তার পরবর্তী সময়ে ভারত সহায়ক এবং এক বিশাল ও শক্তিশালী ছায়া ফেলেছিল।
ইমরান খান, জাভেদ মিয়াঁদাদ, কপিল দেব এবং সুনীল গাভাস্কারের মতো নায়কদের বন্দনা বিদেশে অস্বাভাবিক নয়। তবে বাংলাদেশীরা ভারতীয় ও পাকিস্তানি ক্রিকেটারদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংযোগের উপর ভিত্তি করে পছন্দ করত, যেগুলোর মধ্যে রয়েছে সাহিত্য, শিল্প ও সংগীত।
বেশিরভাগ বাসাবাড়িতে হিন্দি সিনেমা এবং গান সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল। সেখানে জনপ্রিয়তার তালিকায় পাকিস্তানি ব্যান্ড, টিভি শো এবং শিল্পীদেরও জায়গা ছিল। পূর্বে ব্রিটিশ ভারতে ক্রিকেটের আগমনের মতই বাংলাদেশে খেলাটির প্রচলন ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম ভারত ও পাকিস্তানের ম্যাচ দেখার মাধ্যমে খেলাটির প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়ে।
আমার উদ্ভাবনী চাচা এবং তাঁর বন্ধুরা ছাদের অ্যান্টেনা বিভিন্ন দিকে ঘুরিয়ে বা অ্যান্টেনার ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য রান্নাঘরের থালা সেখানে জুড়ে দিতেন (আপনি ঠিকই পড়ছেন) যাতে করে সীমান্তের ওপার থেকেও দূরদর্শন চ্যানেলে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ দেখতে পারেন। বাংলাদেশ টেলিভিশন তখন শুধু শারজায় অনুষ্ঠিত ম্যাচগুলি সরাসরি সম্প্রচার করত।
আমার মত একজন বড় অস্ট্রেলিয়া ভক্তকে অবশ্য অস্ট্রেলিয়া এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজের পুন:প্রচারিত ম্যাচগুলার জন্য আধঘণ্টার সাপ্তাহিক অনুষ্ঠানে সন্তুষ্ট থাকতে হতো এবং ডিন জোনস, ওয়াহ ভ্রাতৃদ্বয়, শেন ওয়ার্ন এবং কার্টলি অ্যামব্রোস সম্পর্কে সন্ধানের জন্য ম্যাগাজিন এবং সংবাদপত্রগুলোর ওপর নির্ভর করতে হতো।
আমার মনে নেই যে, অস্থায়ী কোন অ্যান্টেনা কাজ করেছিল কিনা, তবে আমার পুরো পরিবার ১৯৮৭ সালে পাকিস্তানের ভারত সফর দেখতে সক্ষম হয়েছিল। পরের বছর ঢাকায় যখন এশিয়া কাপ অনুষ্ঠিত হয় তখন একজন ভারত অনুরাগী হিসেবে আমার মা ভারত-পাকিস্তান খেলাটি দেখতে গিয়েছিলেন। তখন আমার বয়স ছিল চার বছর।
আমার দাদি পরবর্তীতে আমাকে জানান যে, সেদিন আমি খুব কেঁদেছিলাম যখন তিনি টেলিভিশনের দিকে আমাকে ইঙ্গিত করেন এবং আমি তাতে আমার মায়ের খোঁজ করছিলাম। সেদিন থেকেই সম্ভবত ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের সাথে আমার ভালবাসা-ঘৃণার সম্পর্ক শুরু হয়েছিল।
আশির এবং নব্বইয়ের দশকে ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন গ্রহণযোগ্য ছিল না। এমনকি নতুন সহস্রাব্দেও এটা গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। এটা আমার কাছে কেবল বিরক্তিকর ছিল।
সময়মত আমি বুঝতে পারি যে আমার সমস্যাটি ম্যাচের সাথে নয়, বরং আমার বন্ধু, চাচাতো ভাই, চাচা এবং চাচী যেভাবে খেলায় প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিলেন তা নিয়ে। আমি ক্রিকেট খেলে বহু সময় অতিবাহিত করেছি কিন্তু এটা কখনই আমার মনে ধরেনি যে, মানুষ ক্রিকেটীয় কারণগুলো ছাপিয়ে অন্যান্য কারণে একটি দলকে সমর্থন করতে পারে।
আমি অস্ট্রেলিয়াকে পছন্দ করতাম এবং নব্বইয়ের দশকে কেবল শীর্ষস্থানীয় এই দলকে সমর্থন করার অভিযোগ আনা সত্ত্বেও আমি তাদের ক্রিকেট পদ্ধতির প্রশংসা করা থেকে বিরত হইনি।
তবুও ভারত-পাকিস্তান প্রতিযোগিতা সম্পর্কে দুটি বিষয় আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। শচীন টেন্ডুলকারের বিপক্ষে ওয়াসিম আকরামের বোলিং দেখে প্রভাবিত হতাম আমি। বিশ্বের সেরা ব্যাটসম্যানের বিপক্ষে বিশ্বের সেরা বোলার!
শেন ওয়ার্নের বিপক্ষে ব্রায়ান লারা এবং ওয়াহর অ্যামব্রোসকে মোকাবেলা করাটাও ছিল সেরকম মানসম্পন্ন প্রতিযোগিতা। তবে শচীন বনাম ওয়াসিম লড়াইকে আমি বাকিগুলোর চেয়ে একটু এগিয়ে রাখব।
আমার কাছে অন্য আকর্ষণীয় দিকটি হলো ওইসব খেলায় স্বল্প পরিচিত ক্রিকেটারদের আলো ঝলকানো পারফরম্যান্স। আমি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন এবং ম্যাগাজিনে, পরে বইগুলোতে নতুন নামগুলি খুঁজে পেতে পছন্দ করতাম।
পাকিস্তানের হয়ে প্রয়োজনের সময় যেমন আকিব জাভেদ, জাহিদ ফজল এবং মঈন খান দাঁড়িয়ে যেতেন তেমনি ভারতের প্রয়োজনে হাল ধরতেন অজয় জাদেজা, নভোজিৎ সিং সিধু এবং লক্ষীপতি বালাজি। তাঁরা প্রায়শই স্নায়ুচাপের ম্যাচে পার্থক্য গড়ে দিতেন এবং ম্যাচগুলাকে মজাদার করে তুলতেন।
বিষয়টা হচ্ছে আমার জন্য এগুলা মজাদার হবার কথা ছিল কিন্তু অন্যদের আবেগ সেটাকে কঠিন করে তোলে। এমনকি এটা এখনও চলমান যখন বাংলাদেশ একটি আন্তর্জাতিক দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যদি ভারত-পাকিস্তান লড়াই বাংলাদেশে বা অন্য কোথাও অনুষ্ঠিত হয় তাহলে এটা বিভাজনের কারণ হয়ে দাঁড়ায় এবং খুব কম সময়ই আলোচনাগুলো ক্রিকেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকতে দেখা যায়। বর্তমানে মনে হচ্ছে যে আসল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয় খেলার আগমুহূর্তে এবং শেষ হবার পর। গত এক দশকে একতরফা ম্যাচগুলোর সংখ্যাও এতে কোন প্রকার পরিবর্তন আনতে পারেনি।
তবুও প্রতিবার ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ মানেই দু’দলের দর্শকদের সরব উপস্থিতি। এরকম একটি উপলক্ষ্য এসেছিল ঢাকাতে ২০১৪ এশিয়া কাপে। তখন শেরে বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম দর্শকে প্রায় পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল এবং দুই দলের জন্য সমর্থন ছিল সমান সমান।
লক্ষ্য তাড়া করতে নেমে পাকিস্তান পথ হারানোর পর ম্যাচটি প্রাণ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু শহীদ আফ্রিদির একটি বিশেষ পারফরম্যান্স তাতে পুনরায় প্রাণসঞ্চার ঘটায়। শেষ ওভারে রবীচন্দ্রন অশ্বিনকে ছক্কা হাকিয়ে ম্যাচ জিতিয়ে মাঠ ছাড়েন আফ্রিদি।
ভারতীয় ফিল্ডাররা সহ অর্ধেক জনতা আশা করেছিল যে বলটি সীমানার এপারেই পড়বে হয়ত ক্যাচের জন্য। কিন্তু আফ্রিদি এবং যার মাথার ওপর দিয়ে বলটি সীমানার ওপারে আছড়ে পরে সেই লং অফ ফিল্ডার দু’জনই জানতেন যে এটা ছয় হতে যাচ্ছে।
এটা ছিল সর্বশেষ ভারত পাকিস্তানের মধ্যকার দুর্দান্ত একটি ম্যাচ। আমি আশা হারাইনি। ছেলেবেলা থেকে ঘৃণা করতে ভালবেসেছি যে দ্বৈরথকে তার সামর্থ্য আছে আবারো উত্তেজনাপূর্ণ আবহ ছড়ানোর যখন আপনি অন্তত আশাটা রাখবেন।
– দ্য ক্রিকেট মান্থলি অবলম্বনে