১৯৯৮ সিলভার জুবিলি কাপের ফাইনাল ম্যাচ।
ঢাকার বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে মুখোমুখি চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দুই দল ভারত ও পাকিস্তান। টস হেরে শুরুতে ব্যাট করতে নামা পাকিস্তান ইজাজ আহমেদ এবং সাঈদ আনোয়ারের সেঞ্চুরিতে সংগ্রহ করে ৩১৪ রানের পাহাড়সম এক ইনিংস। জবাবে ব্যাট করতে নেমে সৌরভ গাঙ্গুলির অন্যবদ্য এক শতকে ম্যাচ জিতে নেয় ভারত। সেটাই ছিল ভারতের প্রথম ৩০০-এর ওপরে রান তাড়া করে জয়।
সবাই ম্যাচটা মনে রেখেছে গাঙ্গুলির ম্যাচ হিসেবেই; অথচ ম্যাচটা হতে পারতো তারও। গাঙ্গুলির সাথে গড়েছিলেন ১৭৯ রানের জুটি যা একপ্রকার ম্যাচ থেকে ছিটকে দিয়েছিল পাকিস্তানকে। আকিব জাভেদের হাতে ক্যাচ দিয়ে ফেরার আগে খেলেছিলেন তিনি ৮৩ বলে ৮২ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। আর সেই খেলোয়াড়টি ছিলেন রবিন সিং। ব্যাট কিংবা বল হাতে ভালো করা সত্ত্বেও সবাই যাকে কেবল ভালো ফিল্ডার হিসেবেই বিবেচনা করতো।
ভারতীয় উপমহাদেশ নয়, রবিন সিংয়ের জন্ম সুদূর ক্যারিবিয়ান মুলুকের ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোতে। তার জন্মের প্রায় দেড়শো বছর পূর্বেই তার পূর্ব পুরুষরা ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় মাদ্রাজ থেকে সেখানে পাড়ি জমান। ভারতীয় জাতীয় দলে খেলার আশায় রবিন ভারতে ফিরে আসেন এবং দ্রুতই মাদ্রাজের রঞ্জি ট্রফির দলে জায়গা করে নেন। ভারতীয় বংশোদ্ভূত অসংখ্য ক্রিকেটার ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ক্রিকেট খেলেছেন, তবে ক্যারিবিয়ানে জন্ম নিয়ে এর আগে কোনো ক্রিকেটারই ভারতের হয়ে খেলেননি।
শুরুতে লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাট করলেও মাদ্রাজের হয়ে নতুন বলে বল করতেন তিনি। সেবার সেমিফাইনাল এবং ফাইনালে দারুণ দুটো সেঞ্চুরি করে সবার নজর কাড়েন তিনি। রানের ফল্গুধারা ধরে রাখেন পরের মৌসুমেও, প্রথম তিন ম্যাচেই করেন টানা তিন সেঞ্চুরি।
ফলে নির্বাচকরা আর উপেক্ষা করতে পারেননি, ডাক পান ওয়েস্ট ইন্ডিজ-গামী ভারত দলে। কিন্তু কুইন্স পার্ক ওভালের দুই ওডিয়াইতে মাঠে নামলেএ তেমন কিছু করতে পারেননি। ফলে বাদ পড়েন দল থেকে। কিন্তু রবিন বোধহয় ঘুণাক্ষরেও ভাবেননি পুনরায় দলে ডাক পেতে অপেক্ষা করতে হবে সাত বছর!
মাঝের সাত বছরে ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের বন্যা বইয়ে দিলেও শিকে ছেঁড়েনি রবিনের কপালে। শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলি, যুবরাজ সিংহ, বিনোদ কাম্বলিদের উত্থান তাকে ক্রমেই ছিটকে দিয়েছে জাতীয় দলের দৌড় থেকে। অবশেষে জাতীয় দলের নেটে সৌরভ গাঙ্গুলি ইনজুরির শিকার হলে মোহালিতে অজিদের বিপক্ষে ওডিআইতে ডাক পান রবিন।
টাইটান কাপের সেই ম্যাচে ব্যাট হাতে আলো না ছড়ালেও বল হাতে রবিন তুলে নেন স্টিভ ওয়াহ এবং স্টুয়ার্ট ল’র উইকেট। বল হাতে রবিনের চমক অব্যাহত থাকে ফাইনালেও, হ্যান্সি ক্রোনিয়ে এবং ড্যারিল কালিনানের মহাগুরুত্বপূর্ণ দুই উইকেট নিয়ে ভারতকে সেবার শিরোপা জেতান তিনি। অবশেষে ৩৩ বছর বয়সে এসে জাতীয় দলে জায়গা পাকা হয় রবিনের।
সে সময় ভারতীয় দলে একজন হিটারের খুব অভাব ছিল যিনি কিনা শেষের দিকে নেমে দ্রুত কিছুটা রান সংগ্রহ করতে পারবেন আবার বল হাতেও সহায়তা করতে পারবেন। রবিন সিং ছিলেন এই রোলের জন্য পারফেক্ট, তার অপ্রচলিত স্টান্ট সহজেই বোলারদের বিভ্রান্ত করতো। পাশাপাশি রানিং বিটুইন দ্য উইকেটে তার দক্ষতা প্রশ্নাতীত, ফলে বোলাররা সহজেই তার বিপক্ষে চাপে পড়ে যেত। এছাড়া তার শর্ট রানআপে ছোট জায়গায় মিডিয়াম পেস বোলিং মাঝের ওভারগুলোতে বড্ড কার্যকর ছিল।
অ্যাকুরেসি এবং পিচ থেকে প্রাপ্ত সুবিধা কাজে লাগিয়ে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সীমিত ওভারের ক্রিকেটের অন্যতম সেরা বোলার হিসেবে। তিনি ছিলেন তার সময়ের অন্যতম সেরা ফিল্ডার। ভারতীয় ফিল্ডিংকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যান তিনি। স্লিপ কিংবা গালিতে দাঁড়িয়ে অনবদ্য সব ক্যাচ কিংবা ডিরেক্ট থ্রোতে রান আউট করতে তার জুড়ি মেলা ভার।
পাঁচ দিনের ক্রিকেটের চাইতে সীমিত ওভারের ক্রিকেটেই বেশি সফল রবিন। তার টেস্ট ক্যারিয়ার থমকে গিয়েছে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক টেস্ট খেলেই। অন্যদিকে, ২০০১ সালে অবসর নেবার আগ পর্যন্ত সীমিত ওভারের দলে খেলেছেন দাপটের সাথে। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে ভারতের সেরা পারফর্মার ছিলেন তিনি। জাতীয় দলের হয়ে ১৩৬ ওডিআইতে ২,৩৩৬ রান করার পাশাপাশি বল হাতে নেন ৬৯ উইকেট।
খেলা থেকে অবসরের পর ক্রিকেট কোচিংয়ের সাথে জড়িয়ে পড়েন রবিন। ২০০৪ সালে দায়িত্ব নেন হংকং ক্রিকেট দলের, তার অধীনেই প্রথমবারের এশিয়া কাপে কোয়ালিফাই করে দলটি। সহকারী দলগুলো নিয়ে ভালো কাজ করার সুবাদে নিযুক্ত হন ভারতীয় জাতীয় দলের ব্যাটিং কোচ হিসেবে। এছাড়া প্রধান কোচ ছিলেন ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগের (আইপিএল) দল ডেকান চার্জার্সের। বর্তমানে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সের ব্যাটিং কোচ তিনি।
এছাড়াও ক্রিকেটের প্রতি ভালোবাসা থেকে গড়ে তুলেছেন রবিন সিং ফাউন্ডেশন। পিছিয়ে পড়া দেশগুলোকে ক্রিকেটে এগিয়ে নিতে কাজ করে তার এই ফাউন্ডেশন। রবিন সিং হয়তো আহামরি কোনো ক্রিকেটার ছিলেন না, কিন্তু আত্মনিবেদনে কখনও ঘাটতি ছিল না তার। যতদিন খেলে গিয়েছেন মাঠে নিজের সর্বোচ্চটা ঢেলে দিয়েছেন।