উমহাদেশীয় আবেগকে থোড়াই কেয়ার করতেন তিনি

পাবলিক সেন্টিমেন্ট তাঁর বিপক্ষেই ছিল, বোর্ডের ভেতরে ভেতরে অনেকেই তাঁর বিরোধী ছিল, সাবেকদের দুই চোখের বিষ ছিলেন, ছিলেন গণমাধ্যমের খলনায়ক। কেউ তাঁকে নিজের লোক বলে মানতেন না, সবার কাছেই তিনি স্রেফ একজন বাইরের লোক। আমরা আদর করে বলি ‘দ্য আউটসাইডার’। বাজে ভাবে বললে বলা উচিৎ - ‘যাকে কেউ দেখতে পারে না!’ তবে, তাঁর অধীনে দলের সাফল্যে নেচে ওঠার লোকের অভাব ছিল না।

ভারতীয় দল তখন অস্ট্রেলিয়া সফরে। ২০০৮ সালের কথা। ভারতের অবস্থান ঠিক যুৎসই নয়। টেলি কনফারেন্সে নির্বাচকদের বলে বসলেন, ‘তিন সিনিয়র ক্রিকেটারকে এখন সীমিত ওভারের ক্রিকেট থেকে বাদ দেওয়ার সময় চলে এসেছে!’

বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়ার (বিসিসিআই) মসনদ যেন কেঁপে উঠেছিল সেই একটা কথায়। কাঁপিয়ে দেওয়া সেই মানুষটি হলেন এম এস, দ্য গ্রেট মহেন্দ্র সিং ধোনি।

সাংবাদিক ও ক্রিকেট লিখিয়ে গৌতম ভট্টাচার্য একবার লিখেছিলেন, ‘অধিনায়ক এমএসডি’র সবচাইতে বাজে এবং সবচেয়ে দারুণ সিদ্ধান্ত একটাই, সেটা হল ২০০৮ সালে সৌরভ-দ্রাবিড়-লক্ষণকে ওয়ানডে দল থেকে ছেঁটে ফেলা।’ নির্বাচকদের সাথে সেদিনের সেই বৈঠকে এই তিন ক্রিকেটারের কথাই বলেছিলেন ধোনি!

সৌরভ গাঙ্গুলি, রাহুল দ্রাবিড় ও ভিভিএস লক্ষ্মণকে ছাড়া তখন ভারতের মিডল অর্ডারকে চিন্তাই করা যায় না। ভারতীয় সমর্থক কিংবা নির্বাচকরা যেটা ভুলেও ভাবতে পারেন না, সেই সাহসী সিদ্ধান্তটা নিতে পেরেছিলেন ধোনি। পাবলিক সেন্টিমেন্ট তাঁর বিপক্ষেই ছিল, বোর্ডের ভেতরে ভেতরে অনেকেই তাঁর বিরোধী ছিল, সাবেকদের দুই চোখের বিষ ছিলেন, ছিলেন গণমাধ্যমের খলনায়ক।

কেউ তাঁকে নিজের লোক বলে মানতেন না, সবার কাছেই তিনি স্রেফ একজন বাইরের লোক। আমরা আদর করে বলি ‘দ্য আউটসাইডার’। বাজে ভাবে বললে বলা উচিৎ – ‘যাকে কেউ দেখতে পারে না!’ তবে, তাঁর অধীনে দলের সাফল্যে নেচে ওঠার লোকের অভাব ছিল না।

কিন্তু, এসব উপমহাদেশীয় আবেগকে থোড়াই কেয়ার করতেন তিনি। তাঁর শক্তি ছিল একটাই – নিজের কাজের ওপর শতভাগ আত্মবিশ্বাস। আর সেই আস্থার প্রতিদান তিনি একবার নয় বহুবার পেয়েছেন। সবচেয়ে বেশি পেয়েছেন ২০১১ সালে। ধোনির ছক্কায় যখন ২৮ বছর পর বিশ্বকাপ শিরোপা হাতে তুললো ভারত, তখন বোঝা গেল ঠিক কেন বছর তিনেক আগে সেই অতিসাহসী কাজটা করতে গিয়েছিলেন তিনি!

ধোনি করেছিলেন কারণ তিনি ভবিষ্যৎটা দেখতে পেরেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন ভবিষ্যৎ পাল্টাতে – নিজের ভাগ্য নিজের হাতে লিখতে। সেটা তিনি পেরেছেন। সেটা তিনি ভারতের ক্রিকেটের ‘আউটসাইডার’ হওয়ার পরও সত্য। যতই তাঁর নিন্দুক থাকুক না কেন, সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নেয় যে – ভারতীয় ক্রিকেট তো বটেই বিশ্ব ক্রিকেটের ইতিহাসেও এমন অধিনায়ক আর আসেননি।

আইসিসির বড় তিনটি ইভেন্টের সবগুলো ট্রফি অধিনায়ক হিসেবে জয় করা তো আর ছেলের হাতে মোয়া নয়, সেটা বোঝার মত বোধ ধোনির নিন্দুকেদের আছে। এর বাইরে ব্যাট হাতে কত-শত অসম্ভব ম্যাচ যে তিনি ভারতীয় ক্রিকেট দলকে জিতিয়েছেন, সেই নিয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ খরচ করা যাবে। ওয়ানডে ক্রিকেটের সেরা ফিনিশার কে? এই প্রশ্নে আজকাল আর কেউ অস্ট্রেলিয়ার মাইকেল বেভানের নাম নেয় না, সবার আগে আসে ধোনির নাম।

তবে, একটা ব্যাপার খচখচ করবেই চিরকাল। এম এস ধোনির বিদায়টা কি ঠিক ধোনির বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের মত হল? কে জানতো তিনটা মর্যাদাপূর্ণ আইসিসি ইভেন্টজয়ী অধিনায়ক এমন নীরবে-নিভৃতে অবসর নিয়ে ফেলবেন ২০২০ সালে? হ্যাঁ, এটাই ধোনি, এজন্য তো তিনি ধোনি। তিনি সর্বকাল সব কিছুতেই নীরব, ভাবলেশহীন ছিলেন। উমহাদেশীয় আবেগের মিছিলে গা ভাসানই বলেই তো তিনি সর্বকালের সেরা।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...