মায়াজালের মাইলফলক

১১ আগস্ট, ২০০৫। ক্রিকেটের কুলীন দুই সদস্য মুখোমুখি হয়েছে ঐতিহ্যবাহী অ্যাশেজে। সেবারের অ্যাশেজ জমে উঠেছিল বেশ, তৃতীয় টেস্ট শুরুর আগে দুই দলই সমতায়। কিন্তু ম্যাচের ফলাফলের চেয়ে দর্শকেরা বেশি উত্তেজিত ছিলেন শেন ওয়ার্ন কখন বল করবেন সেটা নিয়ে।

৬০০ উইকেট মাইলফলক ছোঁয়ার দিন যে বারবার আসে না। টস জিতে যেন দর্শকদের দাবি মেনেই ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নিলেন ইংরেজ দলপতি মাইকেল ভন। কিন্তু কিছুতেই উইকেটের দেখা পাচ্ছিলেন না ওয়ার্ন।

ক্রিজে যেন গেড়ে বসেছিলেন মাইকেল ভন এবং মার্কাস টেসকোথিক। অবশেষে ৪১ তম ওভারে আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। টিপিক্যাল ওয়ার্ন ডেলিভারি, সুইপ করতে গিয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ দিলেন টেসকোথিক।

আরো একবার গিলক্রিস্ট – ওয়ার্ন যুগলবন্দী, ৬০০ উইকেটের সিংহাসনে তখন একক আধিপত্য ওয়ার্নের। পুরো স্টেডিয়ামভর্তি দর্শক দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল ওয়ার্নকে, যেন মেনে নিল স্পিন সাম্রাজ্যে অজি জাদুকরের শ্রেষ্ঠত্ব।

টেস্ট ইতিহাসের প্রথম বোলার হিসেবে ছয়শ উইকেটের মাইলফলকে পৌঁছান ওয়ার্ন। ব্যাস, লেখা হয়ে গেল নতুন ইতিহাস।

অথচ ওয়ার্নের ক্যারিয়ারের শুরুটা হয়েছিল যতটা বাজে হওয়া সম্ভব ঠিক ততটাই। পেস বোলিংয়ের আধিপত্যের মাঝেই বিশ্বমঞ্চে আবির্ভাব ওয়ার্নের। ১৯৯২ সালে সিডনিতে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক ঘটে ওয়ার্নের।

অভিষেক ম্যাচে ১৫০ রান খরচ করে কেবলমাত্র একটি উইকেট নিতেই সক্ষম হন। পরের টেস্টে ৭৮ রান দিয়ে থাকেন উইকেটশূন্য। ফলশ্রতিতে বাদ পড়ে যান দল থেকে। তখন ওয়ার্নের ভয়াবহ দু:সময়।

কিন্তু, যার জন্মই হয়েছে লেগ স্পিনের মায়াজালে পুরো বিশ্বকে মোহাবিষ্ট করতে তিনি কি এত সহজে হার মানবেন। দল থেকে বাদ পড়লেও চালিয়ে গেলেন কঠোর পরিশ্রম। ফলে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে দলে আবারো ডাক পান তিনি।

সেই সফরেই ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরে যায় ওয়ার্নের। শ্রীলঙ্কার নিশ্চিত জেতা ম্যাচ একাহাতে বের করে আনেন। ১১ রানে তিন উইকেট নিয়ে একাই হারিয়ে দেন লঙ্কানদের। এরপর আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

মাইক গ্যাটিংয়ের বিপক্ষে তাঁর করা বলটা হয়ে আছে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ডেলিভারি হিসেবে। লেগ স্ট্যাম্পে পিচ করে গ্যাটিংকে হতভম্ভ করে দিয়ে ফেলে দেয় অফস্ট্যাম্পের বেল। গ্যাটিংয়ের পাশাপাশি সেদিন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল পুরো বিশ্ব।

সেই ডেলিভারির বিস্ময় আজো কাটেনি। আজো সেই ডেলিভারিটাই ইতিহাসের সেরা কি না সেই নিয়ে আলোচনা হয়। আর এই আলোচনার খোড়াকটা ক্যারিয়ারজুড়ে যুগিয়ে গেছেন ওয়ার্ন। কারণ, এরপর সময় যত গড়িয়েছে ওয়ার্ন হয়েছেন ততটাই বিধ্বংসী।

তাঁর মায়াবি স্পিন পড়তে না পেরে উইকেট বিলিয়ে দিয়ে এসেছেন ব্যাটসম্যানরা। ১০০, ২০০, ৩০০, ৪০০, ৫০০ উইকেটের মাইলফলক ছাড়িয়ে গিয়েছেন অবলীলায়। নিজেকে এমন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন যেখানে যাবার কথা কল্পনাও করেন না অনেকে।

কেবল লাল বলের ক্রিকেট নয় সাদা বলের ক্রিকেটেও ছিলেন সমান উজ্জ্বল। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে পুনরুদ্ধার করেছেন বিশ্বকাপ। ক্যারিয়ারের শুরুতে যতটা অনুজ্জ্বল ছিলেন ক্যারিয়ারের পরের দিকে ছিলেন ততটাই উজ্জ্বল। সময়ের সাথে সাথে নিজের অস্ত্রকে আরো শাণিত করেছেন ওয়ার্ন।

৬০০ উইকেটের রেকর্ডে পৌঁছাতে ওয়ার্নের খেলতে হয়েছে ১২৬ ম্যাচ আর সময়ের হিসেবে ১৩ বছর ২২ দিন। পরবর্তীতে অবশ্য তার রেকর্ড ভেঙে দেন মুত্তিয়া মুরালিধরন। যদিও মুরালি তাঁর ক্যারিয়ারের বেশিরভাগ ম্যাচ খেলেছিলেন উপমহাদেশের স্পিন সহায়ক উইকেটে।

অন্যদিকে ওয়ার্নকে বেশিরভাগ সময় খেলতে পেস বোলিং সহায়ক সবুজ উইকেটে। পরবর্তীতে অনিল কুম্বলে এবং জেমস অ্যান্ডারসনও স্পর্শ করেন ৬০০ উইকেটের চূঁড়া। শেন ওয়ার্ন ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ৭০৮ উইকেট নিয়ে।

মুত্তিয়া মুরালিধরণ নাকি শেন ওয়ার্ন? – কে ইতিহাসের সেরা স্পিনার? – এটা ক্রিকেট ইতিহাসের খুব মুখরোচক বিতর্ক। তবে, যতই বিতর্ক হোক এক বাক্যে কাউকেই কারো চেয়ে এগিয়ে রাখা যায় না।

তিনি যখন ক্যারিয়ার শুরু করেন তখন চলছে পেস বোলারদের রাজত্ব। তাদের মাঝেও নিজেকে আসীন করেছেন সিংহাসনে। লেগস্পিনের শিল্পটাকে ছড়িয়ে দিয়েছেন পরবর্তী প্রজন্মের কাছে।

আব্দুল কাদির মৃতপ্রায় লেগস্পিনকে পুর্নজাগরণ ঘটিয়েছেন আর তাকে পূর্ণতা এনে দিয়েছেন শেন ওয়ার্ন। শেন ওয়ার্নকে নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকতে পারে। মাঠের বাইরে তাঁকে ঘিরে বিতর্কের শেষ নেই। আবার তিনিই যে ইতিহাসের সেরা লেগ স্পিনার – তাতে সন্দেহ করারও তেমন কেউ নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link