শিশিরের মিছিলে নি:শব্দ পতন

ম্যাথু সিনক্লেয়ার – নামটি মনে আছে? যদি মনে না থাকে ‘কুছপরোয়া নেই’। ‘বেস্ট ক্যাচ ইন ক্রিকেট হিস্ট্রি’ লিখে ইউটিউবে সার্চ করতে পারেন এবং ফলাফল হিসেবে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ম্যাচের একটি দৃশ্য আপনার স্ক্রিনে ভেসে আসবেই। জ্যাকব ওরামের বল দারুণভাবে পুল করেছিলেন অজি ওপেনার ম্যাথু হেইডেন, সবাই ভেবেছিলেন বলটা যাচ্ছে বাউন্ডারির বাইরেই। কিন্তু হঠাৎ করে পুরো শরীর হাওয়ায় ভাসিয়ে সিনক্লেয়ারের ডাইভ সাজঘরে ফিরিয়েছিল হেইডেনকে।

ডকল্যান্ডসের দর্শকদের সেদিন অবাক হওয়ার পালা ছিল যখন বল তালুবন্দি করে ওঠামাত্রই দর্শকদের দিকে ইশারা করে কিছু একটা বললেন সিনক্লেয়ার। নেপিয়ারের শান্তশিষ্ট ছেলেটার আক্রমণাত্নক মনোভাব তারা দেখেননি আগে কখনো। তারা কিছু বুঝে উঠতে পারার আগেই সিনক্লেয়ার তার স্বভাবসুলভ হাসি হেসে সতীর্থদের সাথে উদযাপনে যোগ দিলেন।

সেই ঘটনার পর কেটে গিয়েছে ২২ বছর এবং স্বাভাবিকভাবেই ক্রিকেটে লেগেছে পরিবর্তনের হাওয়া। দশ বছর আগেই ক্রিকেট থেকে অবসর নিয়েছেন সিনক্লেয়ার এবং এর মাঝেই দেখে ফেলেছেন জীবনের কঠিন দিকও। ক্রিকেটের বাইরের জীবনসংগ্রাম নিংড়ে বের করে নিয়েছে তার সবটুকু।

টেস্ট অভিষেকেই ডাবল সেঞ্চুরি করা, একই মৌসুমে পাকিস্থানের বিপক্ষে তার পুনরাবৃত্তি করা, কিংবা জাতীয় দল থেকে বারবার বাদ পড়েও হাল না ছাড়া, আবার ঘরোয়া ক্রিকেটে রানের ফুলঝুড়ি ছড়িয়ে জাতীয় দলে ফিরে আসা সবমিলয়ে সিনক্লেয়ারের ক্যারিয়ারটা ছিল পেণ্ডুলামের মতো।

‘আমার টেস্ট ক্যারিয়ারটা ছিল উত্থান-পতনে পরিপূর্ণ। কিন্তু আমার প্রথম শ্রেণীর ক্যারিয়ার খুবই ভালো ছিল। আমার মনে হয় ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মানিয়ে নেয়াটা কঠিন ছিল আমার জন্য। তার উপর, অভিষেকের পারফরম্যান্সের পর আমার উপর বাড়তি প্রত্যাশার চাপ মানসিকভাবে আমাকে কিছুটা পিছিয়ে দিয়েছে’, বলেন সিনক্লেয়ার।

‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাবাহিকতা ধরে রাখা খুবই কঠিন এবং আপনি যদি সেটা করতে না পারেন দল থেকে বাদ পড়তে খুব বেশি সময় লাগবে না। আমি নিজেকে ধারাবাহিক ক্রিকেটার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনাকে মাঠে প্রতিটি মুহূর্তে নিজের সর্বোচ্চটা দিতে হবে। আমি সম্ভবত সেই কাজটাই করতে পারিনি।’, আক্ষেপ ঝরে পড়ে সিনক্লেয়ারের কণ্ঠে।

অভিষেকের ইনিংসের কথা মনে করতে হলে ফিরে যেতে হবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ১৯৯৯ সালের বক্সিং ডে টেস্টে। বর্তমানে কিউইদের কোচ গ্যারি স্টিড আউট হয়ে গেলে তিন নম্বরে ব্যাট করতে নামেন সিনক্লেয়ার। কোর্টনি ওয়ালশ, রেয়ন কিং ও ফ্র‍্যাংকলিন রোজ বিধ্বংসী তিন পেসারের সামনে তরুণ অভিষিক্ত সিনক্লেয়ার। একাদশে জায়গা পাওয়া-না পাওয়া নিয়ে সংশয়ে থাকা সিনক্লেয়ার অভিষেকেই খেললেন ৪৪৭ বলে ২১৪ রানের অসাধারণ ইনিংস।

তিনি বলেন, ‘আমি আসলে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দলে ছিলাম না কিন্তু ভাগ্যক্রমে সুযোগ পেয়ে যাই। আগের টেস্টে ম্যাট হর্ন আঙুলে চোট পেয়েছিল। তাই তার জায়গায় একজন ব্যাটসম্যান প্রয়োজন ছিল। আমি তখন বেশ ভালো ফর্মে ছিলাম, ঘরোয়া ক্রিকেটে অনেক রান করছিলাম এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজ এ-দলের বিপক্ষেও ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল। সবকিছু একদম ব্যাটে বলে মিলে গিয়েছিল আর কি।’

ওই তিনি ছিলেন বিরাট একটা বিষয়। তিনি বলেন, ‘স্টিভেন ফ্লেমিং আমাকে ফোনে অভিষেকের সংবাদ দেন। আমি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাই এবং ওয়েলিংটনে দলের সাথে যোগ দেবার সময়ও আমার হতবিহবল ভাব কাটেনি। ফ্লেমিংয়ের হাত থেকে টেস্ট ক্যাপ পাওয়া। আহা! সে একটা মুহূর্ত বটে।’

কিন্তু দারুণ এই শুরু পরবর্তীতে ধরে রাখতে পারেননি সিনক্লেয়ার। ক্রিকেট থেকে অবসর নেবার পর বলতে গেলে জীবিকা নির্বাহ করাই তার জন্য দু:সাধ্য হয়ে দাঁড়ায়। সত্যি বলতে ক্রিকেটারদের জনপ্রিয়তা থাকলেও নিউজিল্যান্ডে ক্রিকেট গ্রীষ্মকালীন খেলা ব্যতীত কিছুই না। ২০১৩ সালে ক্রিকেট থেকে অবসর নেবার পর তাই সিনক্লেয়ারের প্রয়োজন ছিল একটা চাকরি জুটিয়ে নেয়া। শুরুতে নেপিয়ারের সেলন অ্যাসিস্টান্টের কাজ পেলেও ঠিক মানিয়ে নিতে পারেননি।

‘আমার পক্ষে জীবিকা উপার্জনের জন্য ক্রিকেটের বাইরে অন্যকিছু করা ছিল রীতিমতো অসম্ভব। ১৭ বছর বয়স থেকে পরের ২০ বছর ক্রিকেটই ছিল আমার ধ্যানজ্ঞান সবকিছু। ক্রিকেটের বাইরে আমি কিছুই ভাবিনি এবং প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে গিয়েছি একজন ভালো ক্রিকেটার এবং ভালো মানুষ হওয়ার। আমি আমার পরিবার, বন্ধুবান্ধব, ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সাথে আলোচনা করেছি কিন্তু দিনশেষে ক্রিকেট আপনার সাথে সারাজীবন থাকবে না। একটা সময় আমি বুঝতে পেরেছিলাম, যে খেলাটাকে সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি সেই ক্রিকেটই জীবনের শেষ কথা নয়।’, বলেন সিনক্লেয়ার।

কিছুদিন পর সিনক্লেয়ার একটা রেডিও শো’র কথা জানতে পারেন যার উপস্থাপক ছিলেন সাবেক ক্রিকেটার এবং বর্তমান ধারাভাষ্যকার মার্ক রিচার্ডসন। সেদিনের অনুষ্ঠানে শ্রোতারা তাঁদের কর্মস্থলের প্রথম দিনের অভিজ্ঞতা ফোনকলে জানাচ্ছিলেন।

একজন শ্রোতা হঠাৎ করে ফোন করেন এবং বলেন, ‘আমি টেস্ট অভিষেকে ডাবল সেঞ্চুরি করেছিলাম।’ কয়েক সেকেন্ড নিরবতার পর মার্ক রিচার্ডসন জিজ্ঞেস করেন, ‘তুমি কি ম্যাথু সিনক্লেয়ার?’

‘হ্যাঁ আমিই সেই। আমাকে কি একটা কাজ খুঁজে দিতে পারো মার্ক?’

সিনক্লেয়ার একটা কাজের জন্য এতটাই মরিয়া ছিলেন যে জনসম্মুখে কাজ চাইতেও দ্বিধাবোধ করেননি। কিন্তু কেউ তাকে চাকরি দেয়নি। সত্যি বলতে দল থেকে বাদ পড়ার চেয়ে কাজ না পাওয়া বেশি কষ্ট দিয়েছিল তাঁকে।

পারিবারিক জীবনেও অশান্তি সৃষ্টি হয় সিনক্লেয়ারের। দুঃখ, কষ্ট, আক্ষেপ, হতাশায় মুষড়ে পড়েন তিনি। আগে কোনো কাজের অভিজ্ঞতা না থাকায় তিনি বুঝতেও পারছিলেন না কোন ধরনের কাজ তিনি করতে পারবেন। সর্বোপরি এর আগে ক্রিকেটের বাইরে তিনি কিছু নিয়ে কখনো চিন্তাই করেননি। তবে সেলস অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে ব্যর্থতা থেকে পাওয়া শিক্ষা কাজে লাগিয়ে হকস বি’তে রিয়েল এস্টেট এজেন্ট হিসেবে কাজের সুযোগ পান। সাতপাঁচ না ভেবেই তিনি কাজে যোগ দেন।

তিনি বলেন, ‘আর্থিকভাবে আমি খুব খারাপ সময় পার করছিলাম। আপনি যখন ক্রিকেট খেলবেন অন্য সবকিছু আপনার জন্য সহজ হয়ে যাবে। ক্রিকেটের বাইরের কিছু নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। কিন্তু ক্রিকেট থেকে অবসরের পর ব্যাপারটা একই থাকবে না। তখনকার সময়ে নিউজিল্যান্ডে কাজ খুঁজে পাওয়াটা খুব একটা সহজ ছিল না।’

‘আপনি যদি কর্ণাটক কিংবা আরসিবির হয়ে খেলেন তাহলে তারা শেষদিন পর্যন্ত আপনার খোঁজ রাখবে। কিন্তু নিউজিল্যান্ডের ব্যাপারটা আলাদা। ক্রিকেট এখানে একটা চাকরির মতো, অবসরের পর আপনি একজন সাধারণ মানুষ। তাছাড়া ভারতের মতো সুযোগ-সুবিধাও আপনি এখানে পাবেন না। রাগবি এখানে সবচেয়ে জনপ্রিয় খেলা। ক্রিকেট সম্ভবত তালিকায় দ্বিতীয় বা তৃতীয়তে থাকবে, মূলত এটা একটা গ্রীষ্মকালীন খেলা। ফুটবলও এখন গ্রীষ্মকালীন খেলাতে পরিণত হয়েছে। যার ফলে আমরা অনেক বাচ্চাকে হারাচ্ছি যারা কিনা অন্য খেলাতে বেশি আকর্ষণ খুঁজে পাচ্ছে। অন্যদিকে এখানে ভারতে সবাই ক্রিকেটার হতে চায়।’, যোগ করেন তিনি।

জীবন কিংবা জীবিকা কিছু নিয়ে এখন আর আক্ষেপ কিংবা হতাশা নেই সিনক্লেয়ারের। হকস বে’তে ক্রিকেট কোচিং এবং ভারতের পুনে ও ব্যাঙ্গালুরুতে কোচিং ক্যাম্প পরিচালনা করেই জীবন কাটছে তাঁর। অবশেষে ক্রিকেটের মাঝেই ফিরে পেয়েছেন নিজের জীবনের শান্তি।

তিনি বলেন, ‘আমার কাছে ক্রিকেট কোচিং হচ্ছে ক্রিকেটকে কিছু ফিরিয়ে দেয়া। আমি গ্রীষ্মে আবারো ভারতে ফিরে আসবো। আমি সবসময়ই ভারতে খেলতে চেয়েছি কিন্তু কখনো সুযোগ মেলেনি। ক্রিকেট কোচিং আমাকে সুযোগ দিয়েছে পুরো বিশ্বকে দেখার এবং নিজের জীবিকা নির্বাহের।’

সেলস অ্যাসিসট্যান্ট, রিয়েল স্টেট এজেন্ট, রেডিওতে ফোন করে কাজ চাওয়ার আকুতি সবকিছু পেছনে ফেলে সিনক্লেয়ার নিজের জীবনের প্রশান্তি আবারো খুঁজে পেয়েছেন ক্রিকেটের মাঝে। সকল হতাশা, আক্ষেপ তিনি দূরে ঠেলে দিয়েছেন মিষ্টি হাসিতে। ঠিক যেমনটা তিনি করেছিলেন ২২ বছর আগে ডকল্যান্ডসে।

– স্পোর্টস ক্যাফে অবলম্বনে

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link