রামচাঁদ গোয়ালা চলে গেলেন। দেশের ক্রিকেটের নক্ষত্র এখন কেবলই দূর আকাশের তারা!
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কখনও খেলার সুযোগ হয়নি, আইসিসি ট্রফিও নয়। তবু তিনি কিংবদন্তি। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে আলাদা জায়গা তার সবসময়ই থাকবে।
বাংলাদেশে বাঁহাতি স্পিনারের যে দীর্ঘ মিছিল, তিনি ছিলেন সেটিরই অগ্রপথিক। ঢাকার ক্রিকেট রাঙিয়েছেন তিন দশকের বেশি সময়। ৫৩ বছর বয়সেও খেলেছেন ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে, ভাবা যায়!
১৯৮১-৮২ মৌসুমে যখন আবাহনীতে নাম লেখান, বয়স তখন ৪০ পেরিয়ে গেছে। অথচ সেখান থেকেও প্রায় এক যুগ আবাহনী খেলেছেন দাপটে। এতটাই দুর্দান্ত ছিল তার পারফরম্যান্স যে ক্লাবের সমার্থক হয়ে গিয়েছিলেন, লোকে বলত, ‘আবাহনীর গোয়ালা।’ বিসিবি পরিচালক ও দীর্ঘদিনের ক্রিকেট সংগঠক আহমেদ সাজ্জাদুল আলম, আমাদের প্রিয় ববি ভাই বলছেন, ‘আবাহনীর এরকম প্রতীক বা আইকন হয়ে উঠেছিলেন গোয়ালা দা’।
লম্বা বাবরি চুল আর পুরু গোঁফের গোয়ালা ছিলেন দারুণ দর্শকপ্রিয়। ছিলেন বিশাল হৃদয় ক্রিকেটার, নিজেকে উজার করে দিতেন মাঠে। মাঠের বাইরে মাতিয়ে রাখতেন সবাইকে।
১৯৪১ সালে ময়মনসিংহে তার জন্ম।ময়মনসিংহের আর সবার মতো, সার্কিট হাউস মাঠেই তার শুরু। ছেলেবেলায় ছিলেন পেসার। স্কুল ক্রিকেটে খেলার সময় স্পিন শুরু করে সেটিতেই থিতু হন। মাত্র ১৪ বছর বয়সে পন্ডিতপাড়া ক্লাবের হয়ে ময়মনসিংহ লিগে শুরু হয় তার যাত্রা।
ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটে অভিষেক ১৯৬২ সালে ভিক্টোরিয়ার হয়ে। ঢাকার ক্রিকেটে তখন ময়মনসিংহের অনেক ক্রিকেটার। বলা হতো, ময়মনসিংহের লোকাল ট্রেন ঢাকায় না পৌঁছালে লিগের খেলা শুরু হতো না। গোয়ালা ছিলেন সেই ট্রেনের নিয়মিত যাত্রী।
১৯৬৭ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত ক্রিকেট থেকে দূরে চলে যান ব্যক্তিগত কারণে। তবে একটা সময় অভিমান ভুলে আবার ফেরেন মাঠে। ১৯৭৪ সালের লিগে ওই মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন দল ভিক্টোরিয়ার বিপক্ষে টাউন ক্লাবের হয়ে নিয়েছিলেন ২৩ রানে ৭ উইকেট। ওই পারফরম্যান্সের পরই তাকে প্রস্তাব দেয় মোহামেডান। ১৯৭৫ সালে নাম লেখান মোহামেডানে। ১৯৮১-৮২ থেকে আবাহনীতে।
সেই থেকে আবাহনী ক্লাবই ছিল তার ঘরবাড়ি। ক্লাবে থাকতেন, খেতেন, ওই বয়সেও সকাল-দুপুর-বিকেল ক্লান্তিহীন চলত তার প্র্যাকটিস। কোনো কোনোদিন রাতেও, ইনডোরে বোলিং করতেন তরুণ কোনো ব্যাটসম্যানকে। এজন্যই হয়তো বয়স তাঁর পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারেনি।
জাতীয় দলের হয়ে আশির দশকের শুরুর দিকে পশ্চিমব্ঙ্গ সফরে গিয়েছিলেন। অরুণ লাল তখন ভারতের টেস্ট ওপেনার। গোয়ালা সেই অরুণ লালকে ভুগিয়েছেন যথেষ্ট। জাতীয় দলের হয়ে পরে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষেও খেলেছেন আন-অফিসিয়াল ম্যাচ। ঢাকা লিগে মোহামেডানে খেলতে আসা অর্জুনা রানাতুঙ্গা, অরবিন্দ ডি সিলভার উইকেট নিয়েছেন আবাহনীর হয়ে। তার সবসময়ের প্রিয় ক্রিকেট স্মৃতি ছিল ওই উইকেট জোড়া।
আবাহনী চ্যাম্পিয়ন হলেই তখন মিষ্টি নিয়ে ক্লাবে চলে যেতেন শেখ হাসিনা। সবাইকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন। ক্লাবের সবাই তখন গোয়ালা দা বলতে পাগল। মুখে মিষ্টি তুলে দিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘আপনি যখন সবার দাদা, আমারও দাদা।’
ঢাকার ক্রিকেটে শেষবার খেলেছেন ৫৩ বছর বয়সে, জিমএমসিসির হয়ে। গ্রেটার মাইমেনসিং ক্রিকেট ক্লাব। হারিয়ে যাওয়া ক্লাবটির নাম এখনকার যুগের অনেকেরই অজানা। ঢাকার ক্রিকেটে তাদের অনেক অবদান। মূলত বৃহত্তর ময়মনসিহের ক্রিকেটারদের নিয়ে গড়া ক্লাব। আমি ছোটবেলায় পত্রিকায় দেখতাম, মাঝারি শক্তির জিএমসিসি মাঝেমধ্যেই আবাহনী-মোহামেডান-বিমানের মতো দলকে হারিয়ে দিত। লিগে রানার্স আপও হয়েছিল তারা। এই ক্লাবকে কোচিং করিয়েছেন গোয়ালা।
ববি ভাই বলছেন, বাংলাদেশে তার দেখা সেরা বাঁ-হাতি স্পিনার গোয়ালা। হ্যাঁ, এখনকার সবাইকে মাথায় রেখেই বলছেন। ৬ ফুটের ওপর লম্বা ছিলেন, উচ্চতাকে কাজে লাগাতেন। অ্যাকুরেসি ছিল দুর্দান্ত। সঙ্গে ফ্লাইট আর বুদ্ধিদীপ্ত বোলিংয়ে ধরতেন শিকার।
টাকা-পয়সা নিয়ে কখনোই খুব একটা ভাবেননি খেলোয়াড়ী জীবনে। খেলতেন নিজের আনন্দে, খেলে আনন্দ দিতেন সবাইকে। শেষ জীবনে তাই টাকা-পয়সার সমস্যায় ধুঁকতে হয়েছে। বিসিবি অবশ্য সহায়তা করেছে কিছু। বাংলাদেশ স্পোর্টস জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনও করেছে সহায়তা।
তার সংসার-পরিবার, সবই ছিল ক্রিকেট। বিয়ে-থা করেননি কখনও। একবার অবশ্য বিয়ে ঠিক হয়েছিল। তার বাবার ইচ্ছে ছিল, ধুমধাম করে বিয়ে দেবেন। কিন্তু বিয়ের ঠিক আগে আচমকাই তার বাবা মারা যান। ছেলের বউকে দেখে যেতে পারেননি বাবা, এই কষ্টে তিনি আর বিয়েই করেননি জীবনে।
ঢাকার ক্লাব ক্রিকেটের অধ্যায় শেষে ময়মনসিংহেই থাকতেন। ২০০৫ সাল পর্যন্ত ময়মনসিংহ লিগে কোচিং করানোর পাশাপাশি অবিশ্বাস্যভাবে খেলতেনও টুকটাক! এরপরও যতদিন শক্তি ছিল, সার্কিট হাউস মাঠে যেতেন। পরে দুই দফায় স্ট্রোক তাকে আটকে ফেলে ঘরে। শেষ দিকে ঠিকমতো কানে শুনতে পেতেন না। বয়সের কারণে নানা জটিলতাও ছিল।
এখন সবকিছুর অবসান, বাংলাদেশ ক্রিকেটেও যুগের সমাপ্তি!
– ফেসবুক থেকে