আমি বিদ্রোহী রণক্লান্ত

‘হুইসপারিং ডেথ’, মানে ফিসফিস করে এগিয়ে আসা মৃত্যু। ঠিক, তাঁর বোলিং খেলা ছিল ব্যাটসম্যানদের মৃত্যুকে মোকাবেলা করার সামিল। খেলোয়াড়ি জীবনে তিনি কতশত কিংবদন্তিতুল্য ব্যাটসম্যানকে তটস্থ রাখতেন – তাঁর কোনো ইয়ত্তা নেই।

মাঠের জীবন শেষ করে ধারাভাষ্যকারের ক্যারিয়ার গড়েছেন। কি ভেবেছেন, এখানে তিনি ভীতির সঞ্চার করতে পারবেন না? না, মাইকেল হোল্ডিং পেরেছেন। পেরেছেন যেকোনো অনিয়ম বা দুর্নীতির প্রতিবাদ করতে, সরব হয়েছেন ধারাভাষ্যকক্ষে। সেটা করে রোষানলেও পড়েছেন – কিন্তু পিছ পা হননি কখনো।

হোল্ডিং ১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানিয়েছিলেন ১২ বছরের লম্বা ক্যারিয়ার শেষ করে। এরপর ধারাভাষ্যকক্ষে তাঁর বিখ্যাত অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ বিশ্লেষণের জন্য তিনি ব্যাপকভাবে সম্মানিত হয়েছিলেন। সেখানে তিনি কখনো ক্ষেপেছেন, কখনো মুগ্ধ করেছেন, কখনো আবেগাক্রান্ত হয়েছে, কখনো বা আবেগাক্রান্ত করেছেন।

বিশেষ করে আমেরিকায় জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর খেলাধুলা সমাজে বর্ণবাদ নিয়ে বলতে বলতে যখন তাঁর চোখে অশ্রুগঙ্গা বয়ে যায় – তখন তাঁর হয়ে কাঁদে গোটা ক্রিকেট বিশ্বে।

ক্রিকেটে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে এমন বলিষ্ট বক্তব্য এর আগে কখনোই শোনা যায়নি। আসলে ক্রিকেটের যেকোনো ইস্যুতেই মাইকেল হোল্ডিংয়ের কষ্ঠস্বর ছিল বলিষ্ট – যেটা আগে কারো মধ্যে দেখা যায়নি – তাঁর পরেও আর কেউ আসবেন কি না সন্দেহ।

ক্রিকেটের বানিজ্যিকরণের বরাবরই বিপক্ষে ছিলেন মাইকেল হোল্ডিং। টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তিনি কখনো ধারাভাষ্য দেননি। বিপুল অর্থের হাতছানি থাকার পরও যাননি ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল)। সংবাদ মাধ্যম কিংবা প্রতিষ্ঠিত সব ক্রিকেট বোদ্ধারা যেসব সচরাচর মুখে নেন না, সেই সব ইস্যুতে দিব্যি মুখ খুলে ফেলতেন হোল্ডিং।

আইপিএলে কেন আসেন না? – এই প্রশ্নের জবাবে তাঁর উত্তর ছিল পরিস্কার, ‘আমি শুধু ক্রিকেটেই ধারাভাষ্য দিয়ে থাকি!’ শ্লেষ আর বিদ্রুপ মাখা কি পরিস্কার একটা স্টেটমেন্ট।

সর্বশেষ বেফাঁস কথাটা তিনি বলেন ‘বাতিল’ হওয়া ম্যানচেস্টার টেস্টের পর। দাবি করেন, আইপিএলের আগে যথেষ্ট সময় পাওয়ার জন্য বোর্ড অব কনট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই) টেস্টটা নিজে থেকেই খেলতে চায়নি।

‘ক্রিজে আমার সামনে কে আছে – সেটা নিয়ে কখনো ভাবিনি’ – খেলোয়াড়ি জীবনের এই মোটো তিনি পরের জীবনেই ধরে রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন সত্য প্রকাশের অবাধ্য সাহস। যা বলতেন, তাতে খোদ আইসিসিরি মসনদও কয়েক দফা কেঁপে উঠেছিল।

২০১৯ বিশ্বকাপে তিনি অস্ট্রেলিয়া ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের ম্যাচ চলাকালে আম্পায়ারিংয়ের কড়া সমালোচনা করেন। তাঁর ভাষায় সেদিনের আম্পায়ারিং ছিল নৃশংস। আঙুল তুলেছিলেন আইসিসির দিকে। আইসিসি বাধ্য হয়েছিল সম্প্রচারকারী প্রতিষ্ঠানকে চিঠি দিতে। সেখানে সরাসরি হোল্ডিংকে মুখে লাগাম দিতে বলা হয়।

হোল্ডিংকে থামাতে গিয়ে বরং নিজেদেরই বিপদ ডেকে আনে আইসিসি। আইসিসিকে ফিরতি চিঠিতে হোল্ডিং লেখেন, ‘ওই ম্যাচের আম্পায়াররা যদি ফিফা অফিসিয়ালরা হত, তাহলে এতক্ষণে তাঁরা বাড়ি পৌঁছে যেতেন। আর এরপর আর কখনোই তাঁদের বিশ্বকাপের কোনো ম্যাচে দায়িত্ব দেওয়া হত না। একজন সাবেক ক্রিকেটার হিসেবে আমি ক্রিকেটকেই সেই মানদণ্ডে বিচার করি। আর এখানে কি আম্পায়ারদের অপরাধের পক্ষে সাফাই গাওয়া হচ্ছে না?’

এই কড়া বার্তার পর আইসিসিও আর মুখ খোলার সাহস করেনি। কেসটা ওখানেই ক্লোজড। তবে, হোল্ডিং তো বরাবরই ‘নো হোল্ডিং ব্যাক’। তিনি থামেননি, তাঁর ‍মুখে লাগাম দেওয়া অসম্ভব। তিনি দুর্বার, দুর্বীনিত। আপাতত ধারাভাষ্য কক্ষটায় যাতায়াত বন্ধ হলেও কথার এই বাউন্সার ইয়র্কার হয়তো সহসাই থামবে না। কলাম বা বিশ্লেষণ হয়ে সেটা ফিরে ফিরে আসবে বারবার, অনিয়ম আর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘হুইসপারিং ডেথ’ হয়ে।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link