ব্রাজিলের রোনালদোকে প্রায়ই সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার বলা হয়। সাম্প্রতিক বছর গুলোতে একজন ফুটবলারের শ্রেষ্ঠত্ব পরিমাপের বিষয়টা খুব বেশি পরিসংখ্যান নির্ভর হয়ে গিয়েছে বলে মনে হয়। ধরুন, আজকাল মানুষ খুব কমই একজন মিডফিল্ডারকে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় হিসাবে বিবেচনা করে, এক্ষেত্রে সব সময়ই কোন না কোন স্ট্রাইকার বা একজন ফরোয়ার্ড এর নাম চলে আসে এবং তাদের বিচার করার জন্য মানুষ কেবল গোল, অ্যাসিস্ট এবং তারপর যদি তারা কোন ট্রফি জিততে পারে এই হিসেব গুলো করে।
তাই এই সময়টার আগ পর্যন্ত রোনালদোকে সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার ডাকাটা বোধ হয় ঠিক ছিল, কিন্তু ক্যারিয়ারের ৪১৪ গোল করা একজন খেলোয়াড়কে সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইন বলার জন্য তার কেইসটাকে ভিন্ন আলোতে দেখার প্রয়োজনীয়তা তৈরি হয়, বিশেষ করে এই যুগের সমর্থকদের সামনে বিষয়টা পরিস্কার হওয়া উচিত।
আমরা যখন রোনালদোকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ স্ট্রাইকার হিসেবে বিবেচনা করি তখন এটি আসলে রোনালদোর স্বকীয়তাকে সংকীর্ণ করে দেয় কারণ ‘স্ট্রাইকার’ শব্দটি সেই খেলোয়াড়ের সাথেই বেশি যুক্ত হয় যিনি গোল বারের সামনের পজিশনে খেলেন এবং নয় নম্বর জার্সি পরেন। কিন্তু বাস্তবে, রোনালদোর খেলার ধরণ শুধু একজন গতানুগতিক স্ট্রাইকারের রোলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং তিনি ছিলেন এর চেয়ে বেশি কিছু।
এখানে একটা ভিডিওর লিংক শেয়ার করলাম, এটা দেখুন একবার। ভিডিওটা রোনালদোর ১৯৯৮ বিশ্বকাপের স্কিলগুলাকে কম্পাইল করে করা হয়েছে। ওই সময়টা রোনালদোর ফর্মের চূড়ায় বলতে পারেন।
রোনালদো শুধুমাত্র একজন প্রথাগত স্ট্রাইকার ছিলেন না, প্রয়োজনে বল নিতে নিচে নেমে যেতেন, ডিফেন্ডারদের ড্রিবলের মাধ্যমে বিট করতেন হরহামেশাই, নিজে গোল করতেন বা সতীর্থকে সহজ অবস্থানে গোল করার সুযোগ করে দিতেন – এর কারণ তার বলের উপর অসাধারণ দক্ষতা। তিনি কখনো উইঙ্গারের মতো খেলতেন, কখনও কখনও প্লেমেকার – কারণ তার সেই গতি ছিল এবং আর ছিল অসাধারণ দূরদর্শিতা। এর সাথে যোগ হয় তার বাক্সের ভিতরে তার খুরধার স্কিলের সাথে একজন বিশুদ্ধ স্ট্রাইকারের মতো ফিনিশিং দক্ষতা।
রোনালদোর এমন প্রদর্শনী দর্শকরা দেখেছে তাঁর অভিষেক থেকে ২০০৩-০৪ মৌসুম পর্যন্ত। আমার মনে হয় তিনি কখনোই লোন-স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেননি, ইন্টারে ছিল জামোরানো, মাদ্রিদে ছিল রাউল, ব্রাজিলে ছিল রোমারিও/রিভালদো/অ্যাড্রিয়ানো; আর এটাই তাকে মাঠে আরো স্বাধীনভাবে খেলার জায়গা করে দিয়েছে।
অবশ্যই রোনালদোকে ‘সর্বকালের সেরা নাম্বার নাইন’ একারণে বলা হয় না যে তিনি জাস্ট একজন স্ট্রাইকার হিসেবে খেলেছিলেন এবং ‘নয় নম্বর’ শার্ট পরে খেলতেন, বরং তিনি ‘সর্বকালের সেরা স্ট্রাইকার’ এ জন্যই যে – তিনি স্ট্রাইকার পজিশনে খেলা সবচেয়ে সেরা খেলোয়াড়। প্রকৃতপক্ষে, তিনি ছিলেন ‘গ্রেটেস্ট অব অল টাইম’-দের একজন এবং ২৩ বছর বয়স পর্যন্ত ছিলেন দক্ষতার দিক থেকে, শারীরিক দিক থেকে, এবং পরিসংখ্যানগত দিকে থেকে পেলের সবচেয়ে নিকটবর্তী এবং এই সময়ে তিনি দুটি ফিফা সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কারও জিতে নেন।
তিনি ফেনোমেনন হন ইতালিতে, তৎকালীন বিশ্বের সেরা এবং সবচেয়ে কঠিন লিগ। সেখানে যাওয়ার আগে রোনালদো ইতিমধ্যেই ব্রাজিল, নেদারল্যান্ড, স্পেন জয় করে নিয়েছেন। সুতরাং, স্বাভাবিক প্রশ্ন ছিল তিনি কি ইতালিতে একই ছাপ রাখতে পারবেন কিনা?
সাধারণত সর্বকালের সেরা বিচার করার জন্য নির্দিষ্ট খেলোয়াড়কে একটি নির্দিষ্ট মাইলফলক পার করতে হয়। সুতরাং, রোনালদো যদি ইতালিতে নিজেকে প্রমাণ করতে পারে তাহলে মানুষ তাকে প্রজন্মের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হিসেবে গ্রহণ করতে আপত্তি করবে না এবং বাস্তবতা এটাই যে ইতালিকেও তার জয় করতে একটুও সময় লাগেনি। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৯ পর্যন্ত রোনালদো প্রতিটি স্তরে নিজের শ্রেষ্ঠত্বকে প্রমাণ করেছেন একে একে – শুধুমাত্র ১৯৯৮ বিশ্বকাপের ফাইনাল বাদে।
দেখুন, রোনালদো এমন এক পর্যায়ের খেলোয়াড় যিনি এরই মধ্যে পুরো বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে, মানুষ তার দলীয় অর্জন নিয়ে চিন্তিত না, কারণ এটি দিনের আলোর মতো স্পষ্ট ছিল যে তিনি ভিন্ন কাতারের খেলোয়াড় ছিলেন যেটা সেই প্রজন্মের কেউ আগে দেখেনি। আর এটাই মূলত রোনালদোকে ফেনোমেনোনে পরিণত করে। আর এজন্যই নব্বই দশকের উঠতি খেলোয়াড়দের জন্য রোনালদো ছিলেন একজন নায়ক যা তাদেরকে তার মতো খেলার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।
তাহলে সেই উঠতি খেলোয়াড় কারা? উত্তর – ইব্রাহিমোভিচ, দ্রগবা, অঁরি, আগুয়েরো, ইতো, বেনজেমা, মেসি এবং আরও অনেকে। সেই সময়ে রোনালদো একজন পরিপূর্ণ স্ট্রাইকার বা ফরোয়ার্ডের স্ট্যান্ডার্ডটা তৈরি করে দেন, তিনি ১৯৯৯ সালে তার মিশন সম্পন্ন করেছিলেন বিশ্বকাপ জয়ের কাজটা হাতে রেখে।
প্রশ্ন হচ্ছে, কেন ১৯৯৯ এর কথা বললাম? কারণ সে বছর তার প্রথম বড় ইনজুরিতে পড়েন এবং যখন তিনি ছয় মাস পরে ফিরে আসেন ফেরার ম্যাচে তিনি আবার ইনজুরড হন যা তাকে এক বছরেরও বেশি সময় দলের বাইরে রেখেছিল। তার হাঁটুর টেন্ডন ছিড়ে গিয়েছিল ফলে ডাক্তাররা বলেছিলেন যে তিনি হয়তো আর ফুটবল খেলতে পারবেন না। অথবা এর জন্য অলৌকিক কিছু দরকার ছিল এবং অবশেষে অলৌকিক কিছু ঘটেছে।
রোনালদো ২০০২ সালে ফিট হয়ে ফিরে এসে ব্রাজিলের হয়ে বিশ্বকাপ জিতলেন, পুরো টুর্নামেন্টে ৮টি গোল করলেন, ফাইনালে করলেন দু’টি। আর সেই সময়েই রোনালদো ‘সর্বকালের সেরা’ হিসেবে নিজের অবস্থান পাকা করে নেন।