শচীন একটি সাম্রাজ্য

দেশাত্মবোধের আঁচ তার মৃদু ফুলকি নিয়ে দেশপ্রেমিকের কলিজায় আঘাত করলেই জ্বলে ওঠে স্বাধীনতার প্রদীপ। উড়ে চলে পতাকা, একটা মৃদু স্বনিতের বিস্ফোরণ ভাসিয়ে নিয়ে যায় শব্দবন্ধটিকে – ‘জয় হে…’। জাগ্রত হয় কোটি কোটি মানুষ!

সেই বিস্ফোরিত আওয়াজের তীব্র গতিবেগ সজোরে এসে ধাক্কা দেয় ওয়াঘা সীমান্তে, প্রতিধ্বনির স্বরূপ ফিরে আসে আরো এক সমার্থক শব্দ ‘শচীন… শচীন!’

যেন একটা ‘স্ট্রেট ড্রাইভ’ এইমাত্র ভেঙে দিল সীমান্তের রক্তরেখাটিকে। যেন একটা ‘আপার-কাট’ আছড়ে পড়ল লাইন-অফ-কন্ট্রোলের ওপর, যেন একটা ‘স্কোয়ার কাট’ আবার সব্বাইকে ফিরিয়ে আনল গ্যালারিতে!

উড়ন্ত তিন রঙা পতাকার ওপর লেগে রয়েছে ‘জয় হে’র ছাপ। তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে ভারতের একমাত্র দারোয়ান। বিশ্বকাপে নামছে ভারত! স্যাঁতসেঁতে ম্যানচেস্টারে শোয়েব আখতার-ওয়াসিম আকরাম-সাকলাইন মুশতাকরা সেই সেনানীর সামনে কৌশলী সব অস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। আর এমনিতেই ’৯৯ এর বিশ্বকাপ সফরে এখনও পর্যন্ত ভারত ফেবারিট তো নয়ই।

কত হিসেব-নিকেষ, ফলিত বিজ্ঞানচর্চা আর কত স্ট্র‍্যাটেজি-গেমপ্ল্যান তৈরি হয়ে গেছে ম্যাচের আগে। গাভাস্কার থেকে কপিল সবাই প্রায় নির্দেশ দিয়েই দিয়েছেন ম্যানেজমেন্টকে, ‘রাতে প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে বল সাংঘাতিক সুইং করবে শচীন যেন নম্বর চারে আসে, সাইন-সিম নষ্ট হলে তবেই নামবে শচীন।’

প্রেসবক্স থেকে ড্রেসিংরুম আর সমগ্র ভারত সবারই মোটামুটি একই মত; ভারতের একমাত্র রডোডেনড্রনটি যেন শেষ অব্দি দাঁড়িয়ে থাকে মরুভুমির মাঝে। আকরাম-সাকলাইনদের বালিঝড় যেন আঁচড় পর্যন্ত না লাগাতে পারে তাঁকে।

শুধু মতবিরোধী হয়ে গেলেন স্বয়ং শচীন, সেনাবর্মে সজ্জিত হয়ে নেমে পড়লেন এজবাস্টনে; ধুর! ভয়-টয় আবার কি? তাঁর রক্তে নেই কোনো ভয়-ভ্রীতি-শঙ্কা-ত্রাস। শোয়েব-আকরামদের স্যুইং কভার করে একের পর এক বলকে পাঠিয়ে দিলেন বাউন্ডারিতে আর গাঁয়ের ভাঙাচোরা ভিটেবাড়ির একমাত্র রেডিও’র কমেন্ট্রি দিয়ে ভেসে এল ঈশ্বরের কভার ড্রাইভ গুলি – হোয়াট্টা ম্যাগনিফিসেন্ট শট বাই শচীন!’

সেদিনও অক্ষুণ্ণ থেকে গেল বিশ্বকাপে পাক-বধের রেকর্ড, যেন আরো এক কার্গিল আহবে জিতে গেল ভারত আর তার প্রাণবায়ু হয়ে বিরাজ করতে করতে শচীন চলে এলেন ২০০৩ এর বিশ্বকাপ ময়দানে!

বিশ্বকাপে সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক তকমা গায়ে মেখে দেশে ফিরছেন মাস্টার ব্লাস্টার, জেতা হয়নি বিশ্বকাপ। ফাইনালে পন্টিং-হেইডেন-গিলিদের সামনে মুখ থুবড়ে পড়ার কাহিনী আরো তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে চাইছে ভারত, নেই কোনো বিজয়গাথার আগমনীর সুর তবু মুখে চওড়া হাসি শচীনের।

সে মুখখানায় ভেসে উঠছে সেঞ্চুরিয়নের সেই আপার কাট, সেই ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের ওপর দিয়ে উড়ন্ত সাদাবল আর আখতারের আধাপিচ লেংথ ডেলিভারি। ওয়াগান হুইলের ওই কৃত্রিম রেখাটি ক্রমে হয়ে উঠেছে টিম ইন্ডিয়ার উত্থানের সমাক্ষরেখা যে রেখা শচীনীয় সাম্রাজ্যের অঢেল নির্যাস দিয়ে নির্মিত, যে রেখা একটা সীমান্তের ওপর আঁচড় বসিয়ে রেখেছে আজও, যে রেখা টপকে যাবার সাধ্যি আর যাই হোক কোনো মানুষের তো নেই।

তাই তো ভারতীয় ক্রিকেটের ভাগ্যবিধাতার কাছে এমন এক শচীনপ্রাপ্তির চেয়ে আর বড় পাওনা হতে পারে না। আজও মন বলে, শচীন একটি সাম্রাজ্য আর সেই সাম্রাজ্যের মাঝে ‘মিডব্যাট কাভার ড্রাইভ স্ট্রেট ড্রাইভরা’ এক একটি সভ্যতা!’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link