একটা সময় তিনি নিজে আর লিখতে পারতেন না। অন্য কেউ অনুলিখন করতেন। সাহস করে একটা লেখা চেয়ে নিয়েছিলাম খেলা ৭১-এর জন্য। সেটা সেই সময় যখন খেলা ৭১ নিজের উপস্থিতি ঠিক জানান দিতে পারেনি। পালহীন জাহাজের নি:সঙ্গ নাবিক আমি।
তবুও জালাল ভাই আমার মত নগন্য একজনের অনুরোধ ফেরাননি। আমার পাশে এসে জাহাজের পাল তুলে দিয়েছিলেন। কষ্ট করে হলেও, তিনি নিজেই লিখে দিয়েছিলেন, তাঁর ফেসবুকেও প্রকাশিত হয়েছিল। কী মুক্তার মত লেখা! তবুও, বলে দিয়েছিলেন, প্রয়োজনে টুকটাক কারেকশন করে দিতে। খেলা ৭১-এ প্রকাশিত হয় সেই লেখা। তাঁর সুবাদে হলেও একটু একটু করে পাঠক মহল জানতে শুরু করল খেলা ৭১-কে।
একটা সময় খেলা ৭১ একটু একটু করে মাঝ সমুদ্রে সাবলীল ভঙ্গিতে চলতে শুরু করে। জালাল ভাই ছিলেন তখনও, ছায়া হয়ে, কখনো বা অভিভাবক হয়। তিনি ছিলেন আমাদের সোনার কলম। বলে দিতেন, এভাবে-ওভাবে লিখলে আমরাও নাকি সোনার কলম হয়ে উঠতে পারি।
আমরা মনে মনে হাসতাম। বলে কী! জালাল ভাইয়ের মত লেখা অসম্ভব। তবে, জালাল ভাই নিজে হাল ছাড়তেন না। নিজে কোনো অসঙ্গতি দেখলে ধরিয়ে দিতেন। সময়ে-অসময়ে আমাদের ফোনে অতীতের কোনো গল্প বলতেন। তিনি মাশরাফি-আশরাফুলদের কোচ ছিলেন, কোচ ছিলেন আমারও, আমাদেরও।
ঢাকার ক্রিকেট, বাংলাদেশের ক্রিকেটে এমন সত্যিকারের অলরাউন্ডারের দেখা আগে-পরে কখনও পাওয়া যায়নি। ক্রিকেটার হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু। এরপর কখনো ক্রিকেট কোচ, ক্রিকেট আম্পায়ার কিংবা ক্রিকেট সংগঠক – নানা ভূমিকায় দেখা গেছে তাঁকে। এর চেয়েও বড় ব্যাপার হল তিনি ছিলেন ক্রিকেট বিষয়ে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। ক্রিকেটার ও সাংবাদিকদের আড্ডার মধ্যমণি। তাঁর প্রতিটা আড্ডাই একেকটা ক্লাস, কখনো সেটা ক্রিকেটের পাঠ, কখনো বা লেখালেখির পাঠ।
কোচ হিসেবে কত বড় ছিলেন জালাল ভাই? মোহামেডান ও কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের মত দলের কোচিং করিয়েছেন তিনি। এটুকু বলে দিলেই যথেষ্ট। তবে, এর সাথে আরো যোগ করা উচিৎ যে – তিনিই প্রথম বাংলাদেশি কোচ যিনি ভারতের পাতিয়ালা থেকে ক্রিকেট কোচিংয়ের ওপর উচ্চতর ডিগ্রি নিয়ে এসেছিলেন।
১৯৭৯ সালে প্রথম আইসিসি ট্রফি খেলতে যায় বাংলাদেশ দল। সেখানে কোচ হিসেবে ওসমান গনির সাথে জালাল আহমেদ চৌধুরীও ছিলেন। ১৯৯৭ সালে তিনি ছিলেন গর্ডন গ্রিনিজের সহকারী। প্রাথমিক দলটা করেছিলেন জালাল আহমেদ চৌধুরীই।
তিনি আমাদের লেখার সবচেয়ে বড় সমালোচক। কিন্তু, সেই সমালোচনার ভাষাটাও এত বেশি মধুর যে তাতে একমত পোষণ করতে বাধ্য হতেন যে কেউ। নিজের লেখাতেও তেমনই ছিলেন, তাঁর সমালোচনা আজকালকার মতো ধারালো ছিল না, ছিল কাটামুক্ত গোলাপ ফুল। সহনশীলতা, পরিমিতিবোধ, নিরাসক্ত থাকা, লেখায় স্থিতিশীলতা আনা – এসব ব্যাপার তাঁর চেয়ে ভাল বাংলাদেশে আর কেউ বুঝতে পারতো না। আবেগের মধ্যে থেকে গল্পের ছলে ফ্যাক্ট বলা যায় – সেটা তিনি না থাকলে বুঝতাম কি করে!
পার্থিব বাস্তবতায় অপরিহার্য্য কেউ নয়, ক্রিকেটে তো নয়ই। কিন্তু জালাল আহমেদ চৌধুরীর বিকল্প কই? আমি খুঁজে পাই না, পাওয়া সম্ভব নয়!
ক্রিকেটের ভাষায় তাই তিনি অলরাউন্ডার। আমাদের জন্য সোনার কলম। সেই সোনার কলমটা আর নেই। হারিয়ে গেছে। চলে গেছে জীবন নদীর ওপারে। লিখছি আর ভাবছি, কি শিরোনাম দিবো? জালাল ভাই থাকলে বলে দিতে পারতেন। পছন্দ না হলে একটু স্নেহমাখা বকুনি দিয়ে ঠিক করে দিতে পারতেন।
জালাল ভাই, শিরোনামটা ঠিক করে দিতেও কি আর আসবেন না? আমরা এখন কার কাছে যাবো?