প্রেরণা জুগিয়েছেন, পথ বাতলে দিয়েছেন

আজকের দিনটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের নয় হয়তো। সজল চোখে লেখাও কঠিন। তবু কত কিছু যে মনে পড়ছে! বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনে যখন প্রথম আলোর স্টেডিয়াম পাতায় জালাল ভাইয়ের লেখার পাশে আমার লেখা পাশাপাশি ছাপা হলো, বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি অনেক দিন। পরে এই পেশায় এসেছি, তাঁর ছায়া পেয়েছি। । কত আড্ডা-কথা, কত ভালোবাসা!

জালাল ভাই সব্যসাচী। অনেক পরিচয়। আমার কাছে সবচেয়ে বড় পরিচয়, তিনি ক্রিকেটপ্রেমী। তিনি শুদ্ধতার । প্রতীকএই বাংলাদেশে এখন মোটামুটি ১৭ কোটি ক্রিকেটপ্রেমী। এই পরিচয় আর এমন কী!

তবু এখানেই তিনি অনন্য। অসাধারণ। ক্রিকেটকে তার মতো করে ভালোবাসতে, ধারণ করতে, চর্চা করতে ও ফুটিয়ে তুলতে আর কাউকে দেখিনি।

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম বিসিএসে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষায় টিকেও তিনি যাননি ক্রিকেটের টানে। আমেরিকার গ্রিন কার্ডের মায়া ফেলে চলে এসেছিলেন দেশ ও দেশের ক্রিকেটের টানে।

তিনি বলতেন, ক্রিকেট তাঁর জীবনের বড় শিক্ষক। আমরা জানি, ক্রিকেট আসলে ছিল তাঁর জীবন। তিনি ক্রিকেট খেলেছেন। মূলত ছিলেন ব্যাটসম্যান, পাশাপাশি কিপিং করতেন, অফ স্পিনও করতেন। তিনি পাতিলায়ায় গিয়ে কোচিং কোর্সে প্রথম হয়ে দেশে ফিরে শুরু করেছেন কোচিংয়ের অধ্যায়। আবাহনী, মোহামেডান, ভিক্টোরিয়া, ধানমণ্ডি, ইয়াং পেগাসাস, সাধারণ বীমা, কলাবাগান, কত কত ক্লাবে কোচিং করিয়েছেন।

১৯৭৯ সালে দেশের প্রথম আইসিসি ট্রফি অভিযানে তিনি ছিলেন কোচ (সঙ্গে ওসমান খান)। ১৯৯৭ আইসিসি ট্রফি জয়ের প্রাথমিক অভিযান শুরু তার হাত ধরেই। কয়েক প্রজন্মের কত কত ক্রিকেটার তার হাতে গড়া! কাজ করেছেন বিসিবির গেম ডেভেলপমেন্ট, ক্রিকেট অপারেশন্স, আম্পায়ার্সসহ নানা কমিটিতে।

সাংবাদিকতা করেছেন নিউ নেশন আর টাইমস-এ। দেড় যুগ। ইংরেজি পত্রিকায় কাজ করেছেন। ফুল ফুটিয়েছেন বাংলা অক্ষরে। ব্যাট-বলের তুকতাক তার লেখনিতে পেয়েছে ভিন্ন মাত্রা। ক্রিকেটে শিল্প-সাহিত্যের সংযোগ এতটা গভীর, এতটা বাস্তব আর এতটা দারুণভাবে আর কে পেরেছেন আমাদের দেশে!

কী সমৃদ্ধ শব্দ ভাণ্ডার, ভাষার কী অবিশ্বাস্য প্রয়োগ, আর কত যে মমতা! খেলাটির প্রতি মায়া, খেলাটির প্রতি তীব্র আবেগ, সব ফুটে উঠেছে তাঁর লেখায়, সেটা কেবল একটি লাইন হোক বা ১০০ শব্দ কিংবা হাজার হাজার শব্দ। একটি শট, একটি ডেলিভারি, একটি স্পেল, ক্রিকেটের ছোট ছোট কতকিছু নিয়ে তিনি মোহাবিষ্ট থেকেছেন। লেখায় তা ফুটিয়ে তুলে আমাদের ঘোর লাগিয়েছেন।

সব ক্রিকেটকে ভালোবেসে। নিখাঁদ ভালোবাসা। জীবনের মতো ভালোবাসা। এজন্যই তিনি আমার কাছে সবকিছুর ওপরে একজন ক্রিকেটপ্রেমী।

ক্রিকেটের এখন আবেদন বাড়ছে, নিবেদন কমছে। সময়টা অস্থির। এই ক্ষয়ে যাওয়া সময়েও তার মতো একজন শুদ্ধতার প্রতীক ঠিকই রয়ে গেছেন প্রাসঙ্গিক। কারণ, তিনি আর ক্রিকেট, পরস্পর যে বড্ড আপন। সব শেষ হয়ে গেল। জানি না, তাঁর অসীমে যাত্রায় ক্রিকেট কতটা থাকবে।

কিংবা, কিছুই হয়তো শেষ হলো না। দেশের ক্রিকেট যতদিন থাকবে, তার উপস্থিতিও থাকবে, প্রবলভাবে না হোক, অন্তত ছায়া হয়ে, মায়া হয়ে। এমন ক্রিকেটপ্রেমী যে আর হয় না।

আজকের দিনটি ব্যক্তিগত স্মৃতিচারণের নয় হয়তো। সজল চোখে লেখাও কঠিন। তবু কত কিছু যে মনে পড়ছে! বিশ্ববিদ্যালয়ের হল জীবনে যখন প্রথম আলোর স্টেডিয়াম পাতায় জালাল ভাইয়ের লেখার পাশে আমার লেখা পাশাপাশি ছাপা হলো, বিস্ময়ের ঘোর কাটেনি অনেক দিন। পরে এই পেশায় এসেছি, তাঁর ছায়া পেয়েছি। প্রেরণা জুগিয়েছেন, পথ বাতলে দিয়েছেন। কত আড্ডা-কথা, কত ভালোবাসা!

খেলার বাইরেও তার পড়াশোনা, যে কোনো বিষয়ে তার জানার গভীরতা, দেশাত্মবোধ, জীবনবোধ, তাঁর কত কিছুই যে বিস্মিত করত নিত্য! কয়েক বছর আগে, একটা বিষয় নিয়ে ফেসবুকে কিছু আক্রমণাত্মক লেখা লিখেছি দেখে একদিন মাঠে হাতদুটো ধরে অনেক বুঝিয়ে বললেন, ‘কথা দাও, আর নয়।’

অভিভাবক হারানোর হাহাকার কি শুনতে পাচ্ছেন, জালাল ভাই?

– ফেসবুক থেকে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...