দীর্ঘ ব্যর্থতার বৃত্ত ভাঙার স্বপ্ন

বাংলাদেশের কাছে সাফ চ্যাম্পিয়শিপ মানে বিশ্বকাপের মতো। নয়তো এখন পর্যন্ত ১২টি আসরে অংশ নিয়ে মাত্র একটিতে শিরোপা জয়ের কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছে, বাকি আসরে হতাশাই সঙ্গী হয়েছে। আর সর্বশেষ চারটি আসর থেকে ফিরতে হয়েছে খালি হাতে। যার মধ্যে ২০১৮ সালের সর্বশেষ আসরটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল আবার রাজধানী ঢাকায়। আর ২০০৩ সালে শিরোপা জেতার পর সময়ের হিসেবে কেটে গেছে ১৮ বছরেরও বেশি সময়।

জাতীয় দল পাঁচ বছর পর মালদ্বীপে খেলতে গেছে। যদিও গেল আগষ্টে এএফসি কাপ খেলতে দ্বীপ রাষ্ট্রটিতে গিয়েছিল বসুন্ধরা কিংস। তিন ম্যাচে অংশ নিয়ে এক জয়, এক ড্র আর এক পরাজয়ে শেষ হয়েছে এবারের আসর। পরের রাউন্ডে যেতে না পারার হতাশা বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়ন দলটির কোচ, খেলোয়াড় আর কর্মকর্তারা কেউ লুকাতে পারেনি।

এএফসি কাপের ব্যর্থতা থেকেই এবার সাফে সফলতা পেতে চাইছে বাংলাদেশ। ঢাকা আবাহনী লিমিটেড, সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব, বসুন্ধরা কিংস সাম্প্রতিক সময়ে দেশটির রাজধানী মালে সফর করলেও জাতীয় দলের সর্বশেষ সফর ছিল ২০১৬ সালে। বেলজিয়ান কোচ টম সেইন্টফিট মালদ্বীপের সঙ্গে একটি প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল সেবার। ওই ম্যাচে বাংলাদেশ ৫-০ গোলের বড় ব্যবধানে পরাজিত হয়েছিল বাংলাদেশ।

২০১৬ সালের আগে মালে সফরটি ছিল প্রায় ১৬ বছর আগে। ২০০০ সালে একটি আমন্ত্রণমূলক টুর্নামেন্ট খেলতে মালদ্বীপ সফর করেছিল বাংলাদেশ। এরপর আর দীর্ঘ সময় দেশটিতে আসা হয়নি জাতীয় দলের ব্যনারে। এবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ তাই বড় একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশের জন্য। তাতে বড় ধরনের শুন্যতা বলতে হলে সেটি এলিটা কিংসেলেকে নিয়ে। নাইজেরিয়ান থেকে বাংলাদেশি হয়ে যাওয়া এই নামআবর নাইনকে ছাড়াই ফাইনাল খেলার স্বপ্ন দেখছে বাংলাদেশ।

এর আগে ২০১১, ২০১৩, ২০১৫, ২০১৭ টানা চারটি সাফ ফুটবল চ্যাম্পিয়নশিপে গ্রæপ পর্বের বাঁধা টপকাতে পারেনি বাংলাদেশ। বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা ম্যাচ দিয়ে ১ অক্টোবর মালদ্বীপে শুরু হতে যাচ্ছে ১৩তম আসর। অতীতের ব্যর্থতা ঘুচিয়ে এবার ফাইনালে চোখ রেখে ‘কাজ’ করছে বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশনের (বাফুফে) জাতীয় দল ব্যবস্থাপনা কমিটি। শিরোপার চোখ অধিনায়ক জামাল ভুঁইয়ার, সাথে আপদকালীন কোচ অস্কার ব্রæজোন চান আক্রমনাত্মক ফুটবল উপহার দিয়ে ফাইনাল নিশ্চিত করতে।

প্রথম লক্ষ্য শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে জিতে আসর শুরু করতে চায় লাল সবুজ প্রতিনিধিরা। কিছুটা দূর্বল প্রতিপক্ষ হলেও অধিনায়ক লঙ্কানদের বিপক্ষে জয়ের ব্যপারে বেশ সিরিয়াস, ‘সাফের মতো টুর্নামেন্টে ছোট কিংবা বড় দল বলে কিছু নেই। আমাদের প্রথম ম্যাচ যেহেতু শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে, তাই তারাই এখণ মূল প্রতিদ্বন্ধী। প্রথম ম্যাচে তিন পয়েন্ট পেলে ভালো শুরু করে পরের ম্যাচগুলোতে কাজে দেবে।’

অধিনায়ক প্রত্যাশায় ছিলেন সাফের দলে এলিটা কিংসেলেকে পাওয়ার। এমনিতেই দক্ষ গোল স্কোরারের অভাব বাংরাদেশ জাতীয় দলে বেশ প্রকট। এলিটা দলে থাকলে সেটি কিছুটা হলেও পূরণ হতো। এখন লাল-সবুজ জার্সি গায়ে চড়ানোর অপেক্ষার প্রহর বেড়েছে এই নাম্বার নাইনের। ফিফা-এএফসি থেকে চূড়ান্ত ছাড়পত্র না পাওয়ায় সাফে খেলা হচ্ছে না সদ্য বাংলাদেশি হওয়া এই ফরোয়ার্ডের।

দল ঘোষণার আগ পর্যন্ত বাফুফে এলিটাকে খেলাতে ফিফা-এএফসির সঙ্গে যোগাযোগ চালিয়ে গেলেও কোন ফল মেলেনি। তবে এলিটাকে দলে টানতে আরও একটু অপেক্ষা করার সুযোগ ছিল কোচ অস্কার ব্রæজোনের সামনে। টুর্নামেন্ট শুরুর আগে ম্যানেজার্স মিটিংয়ে দিতে হতো চুড়ান্ত খেলোয়াড় তালিকা। যদিও তার আগেই ২৩ জনকে চূড়ান্ত করে ফেলেন এ স্প্যানিশ কোচ। এবার বাংলাদেশের সামনে সাফে ভাল করতে দারুণ একটা সুযোগ রয়েছে বলে মনে করেন ২০১৩ কাঠমান্ড সাফে নেপালের বিপক্ষে ২-০ গোলে হারা ম্যাচে লাল-সবুজ জার্সিতে অভিষেক হয়েছিল জামাল ভুইয়ার।

এরপর খেলেছেন আরও তিনটি সাফ, কাকতালীয়ভাবে প্রতিবারই বিদায় নিতে হয় গ্রæপ পর্ব থেকে। এবার অধিনায়কত্বের আর্মব্যান্ড থাকায় ফাইনাল স্বপ্নে বিভোর জামাল বলেছেন, ভালো ফল নিয়ে মালদ্বীপ থেকে ফিরবেন বাংলাদেশ দল, এবার তেমন দলই নাকি পেয়েছেন তাঁরা।

তবে অনেকের কাছে বাংলাদেশের সাফের ফাইনালে খেলার স্বপ্নটা আকাশ কুসুম।! যে দলটি সর্বশেষ চারটা আসরে গ্রæপপর্বের গন্ডি পেরুতে পারেনি তারা কিনা যাবে ফাইনালে, নিন্দুকেরা এমন কথা বলাবলি করছেন। কিন্তু তাতে কি স্বপ্ন দেখা বারণ। ১-১৬ অক্টোবর মালেতে এবারের সাফে প্রথমদিনই মাঠে নামছে বাংলাদেশ। গ্রæপ ভিত্তিক নয়, রাউন্ড রবীন লিগ পদ্ধতিতে প্রতিটা দল একে অপরের মোকাবেলা করবে। সে হিসেবে এক ম্যাচ খারাপা করলেও পরের ম্যাচে ঘুরে দাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।

পয়েন্ট টেবিলের সবার উপরের দুটি দল ১৬ অক্টোবর ফাইনালে মুখোমুখি হবে। অনেকে আবার জামাল ভূঁইয়ার আত্মবিশ্বাসের প্রশংসা করেছেন! ১ অক্টোবর শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচের ৪, ৭ ও ১৩ অক্টোবর বাংলাদেশ যথাক্রমে খেলবে ভারত, মালদ্বীপ ও নেপালের বিরুদ্ধে মাঠে নামবে। ২০০৩ সালে ঘরের মাঠে অনুষ্ঠিত সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ। দুই বছর পর ২০০৭ সালে দক্ষিণ এশিয়ান ফুটবলের সর্বোচ্চ আসরে রানার্সআপ হয়ে ধারাবাহিকতা ধরে রাখে।

কিছুটা অবনমিত হয়ে ২০০৯ সালে শেষ চার গিয়ে থামে বাংলাদেশের দৌড়। এরপরের চার আসরেই গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল লাল-সবুজ প্রতিনিধিরা। গত এক দশক ধরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের গ্রুপ পর্বে আটকে যাওয়া বাংলাদেশ এবার ২০০৩ সালের সুখস্মৃতিটা ফিরিয়ে আনতে চায়। ঘোচাতে চায় দীর্ঘ দেড় যুগের জমে থাকা আক্ষেপ। ভুটান অংশ না নেওয়ায় এবারের সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ রাউন্ড রবিন লিগ ভিত্তিক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এই প্রতিযোগিতায় র‌্যাঙ্কিংয়ে শুধু শ্রীলঙ্কার (২০৫) ওপরে কেবল বাংলাদেশ।

ভারত (১০৭), মালদ্বীপ (১৬০) ও নেপালের চেয়ে (১৬৮) পিছিয়ে বাংলাদেশ রয়েছে ১৮৯ নাম্বারে। সে হিসেবে বাংলাদেশের ফেবারিট থাকার কথা নয়। ভারতকে ফেভারিট মানলেও শিরোপা জয়ে চোঁখ রেখে জামাল বলেণ, ’বাংলাদেশ কিন্তু সর্বশেষ সাফে ভাল খেলেও গ্রুপ পর্ব থেকে বিদায় নিয়েছিল। নেপালের কাছে না হারলেও বাংলাদেশ ফাইনালে খেলত। আর এবারের আসরে র‌্যাংকিংয়ের দিকে তাকালে অবশ্যই ভারতকে ফেভারিট বলতে হবে। তবুও আমরা ফাইনালে খেলার আশা করছি।

সেখানে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে আমাদের প্রথম ম্যাচটি কঠিন হবে। এরপর ভারতের বিপক্ষে খেলা, সব ম্যাচে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলায় প্রস্তুত রয়েছি’। অব্যহতি পাওয়া কোচ জেমি ডে বরাবরই বাংলাদেশকে ৪-৩-৩ ফরমেশনে খেলাতেন। আর ম্যাচের আগে কখনোই নিজের কৌশল কিংবা ফরমেশন নিয়ে কারো সাথে কথা বলতে চাইতেন না। শুধু সাফের জন্য কোচ হিসেবে বাংলাদেশ দলের দায়িত্ব পাওয়ার পর অস্কার ব্রুজোন পুরোনো ছক থেকে বেরিয়ে আক্রমণাত্মক ৩-৪-৩ ফরমেশনে দলকে খেলানোর পরিকল্পনা করেছেন। নতুন এই কৌশলে খেলতে কোনো সমস্যা হবে না বলে জানিয়েছেন কাপ্তান জামাল। পাশাপাশি ভারতের বিপক্ষে না হেরে ড্র করলেই সম্ভাবনা বেঁচে থাকবে বাংলাদেশের।

সে কারণে আক্রমণাত্মক ফুটবলের ব্রত নিয়েই সাফে গেছে বাংলাদেশ। এবার সাড়ে তিন বছরের রক্ষণাত্মক পরম্পরা ভুলে আক্রমণাত্মক ফুটবল নিয়ে ব্রæজোনের নতুন বাংলাদেশ গেছে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে। জেমি ডে’র রক্ষণাত্মক ফুটবল থেকে বেরিয়ে দলকে আক্রমণাত্মক ফুটবলের ধারায় ফেরানোর কাজ করেছেন এই স্প্যানিশ কোচ। আর এই স্টাইলে খুলতে পারে লাল-সবুজের সাফের গেরো, এমনটাই প্রত্যাশা করা হচ্ছে। এবার সেমিফাইনাল না থাকায় লক্ষ্যটাও তাই ফাইনাল।

জাতীয় দলের খেরায় ফরমেশনের পরিবর্তণ নিয়ে ব্রুজোন বলেন, ‘ফুটবল আসলে অনেব কঠিন খেলা। একটা নতুন স্টাইলে খেলতে এবং তৈরি হতে কিছুটা সময় লাগবে ধরে নিয়ে আমরা কাজ করছি। আক্রমণাত্মক ফুটবল কিভাবে রপ্ত করতে হয় ছেলেদের বোঝানোর চেষ্টা করেছি, তখন তারা কিভাবে রক্ষণ সামালাবে, সে নিয়েও কাজ হয়েছে। আশা করি ছেলেরা মানিয়ে নিতে পারবে।’

কোচ যাই করান না কেন কমপক্ষে ফাইনালে খেলতে পারলে বোঝা যাবে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। ২০০৩ সালে সাফের শিরোপা শুরু ও শেষ হয় একই আসরে। এর বাইরে ১৯৯৯ সালে ভারতের গোয়া ও ২০০৫ সালে পাকিস্তানের করাচি সাফে ফাইনালে ওঠেছিল বাংলাদেশ। পাশাপাশি দুবার সেমিফাইনালে খেলেছিল বাংলাদেশ। বাকি ছয়টি আসর থেকে ফিরতে হয়েছে গ্রুপ পর্বেল গণ্ডি পেরুনোর আগেই। যার মধ্যে রয়েছে সর্বশেষ চারটি আসর।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link