নতুন মোড়কে অনন্য সেনানী

বিশ্বকাপ মানে যেন তাসকিন আহমেদের কাছে অন্য রকম এক অনুভূতি। ২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ যেমন এই পেসারের কাছে স্বরনীয় হয়ে আছে, তেমনি ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এবং ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপ যেন এই পেসারের কাছে একটা আক্ষেপের গল্প। তবে বিশ্বকাপ নাম শুনলে তাসকিনকে হয়তো দুঃসহ স্মৃতি গুলোই সবচেয়ে বেশি তাড়া করে।

২০১৫ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে এই পেসার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স করলেও পরের বছর ভারতে অনুষ্ঠিত হওয়া সর্বশেষ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে তিনি খেলতে পারেননি অবৈধ বোলিং অ্যাকশনের দায়ে অভিযুক্ত হওয়াতে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দলের সাথে গিয়েও প্রথম পর্বে মাত্র দু’টি ম্যাচ খেলে মূল পর্ব না খেলেই দেশে ফিরতে হয়েছিল তাকে।

আর ২০১৯ সালের ওয়ানডে বিশ্বকাপে তিনি দলে ছিলেন না চোটের কারণে। এরপর থেকেই নিজকে হারিয়ে ফেলেন এই পেসার। অনেক চড়াই উতড়াই পার করে আবারো জাতীয় দলে ফিরেছেন তাসকিন। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও দলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ তিনি। মুস্তাফিজুর রহমান, শরিফুল ইসলাম ও মোহাম্মদ সাইফউদ্দিনের সাথে পেস বিভাগের দায়িত্ব সামলাতে দেখা যাবে তাকে।

সাম্প্রতিক সময়ে টি-টোয়েন্টিতে দারুণ সাফল্য পেয়েছে বাংলাদেশ। সর্বশেষ তিনটি সিরিজই জিতেছে বাংলাদেশ। এই তিন সিরিজে পর্যাপ্ত ম্যাচ খেলার সুযোগ না পেলেও যে তিন ম্যাচে সুযোগ পেয়েছিলেন নিজকে মেলে ধরতে পারেননি তিনি। শ্রীলঙ্কা ও জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে দারুণ বল করা তাসকিন জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজের শেষ দুই টি-টোয়েন্টিতে সুযোগ পেয়েও ছিলেন উইকেট শূন্য।

এরপর ঘরের মাঠে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে পাঁচ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজের মন্থর ও টার্নিং উইকেটে টিম কম্বিনেশনের কারণে একাদশে জায়গা পাননি তিনি। পরের সিরিজে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেও কন্ডিশনের কারণে প্রথম চার ম্যাচে সুযোগ পাননি এই পেসার। পঞ্চম ম্যাচে সুযোগ পেয়ে ৪ ওভারে ৩৪ রান দিয়ে এক উইকেট পেয়েছিলেন তিনি।

আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির অতীত রেকর্ডও তাসকিনের হয়ে কথা বলবে না। এই ফরম্যাটে ২৪ টি ম্যাচ খেলে ৮.৪ ইকোনোমিতে ও ৪০.১৩ গড়ে তাসকিন শিকার করেছেন মাত্র ১৫ উইকেট। কোন পাঁচ উইকেট নেই। সেরা বোলিং ফিগার ৩২ রান দিয়ে ২ উইকেট। এছাড়া টি-টোয়েন্টিতে আর কোন ম্যাচে একের অধিক উইকেট পাননি তাসকিন।

কিন্তু একটির বেশি উইকেট না পেলেও কিছু ম্যাচে দারুণ বোলিং করেছেন এই পেসার। টি-টোয়েন্টি অভিষেকে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চার ওভারে ২৪ রান দিয়ে এক উইকেট শিকার করেছিলেন তাসকিন। ২০১৬ সালের এশিয়া কাপে পাকিস্তান ও ভারতের সাথে দুই ম্যাচেই মাত্র ১৪ রান দিয়ে একটি উইকেট পেয়েছিলেন তাসকিন। পাকিস্তানের সাথে করেছিলেন চার ওভার এবং ভারতের সাথে করেছিলেন তিন ওভার।

এছাড়া টি-টোয়েন্টিতে আর কোন বলার মত সাফল্য নেই তাসকিনের। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের গ্রুপ পর্বে স্বাগতিক ওমান, পাপুয়া নিউগিনি ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে খেলবে বাংলাদেশ। পাপুয়া নিউগিনি ও স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে তাসকিন না খেললেও ওমানের সাথে ২০১৬ সালের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে খেলেছিলেন একটি ম্যাচ। ঐ ম্যাচে ২ ওভারে ৮ রান দিয়ে একটি উইকেট পেয়েছিলেন তাসকিন।

তবে অতীত পরিসংখ্যান দিয়ে এই তাসকিনকে বিচার করা ঠিক হবে না। দল থেকে বাদ পড়ার পর ফিরে আসতে তাসকিন নিজকে যে ভাবে তৈরি করেছেন এটা ছিল একেবারে অবিশ্বাস্য। তাসকিন নিজকে সময় দিয়েছেন, ফিটনেসের অভাবনীয় উন্নতি করেছেন, ভালো করার তাগিদ থেকে নিজকে ভেঙেছেন, আবার নিজের মত করেই নিজকে গড়েছেন।

নিজকে পুরোপুরি তৈরি করে দীর্ঘদিন পর দলে ফিরে এই পেসার যে ধারাবাহিকতা দেখিয়েছেন তা বলতে গেলে বাংলাদেশের পেস আক্রমণেই বিরল ঘটনা। এরকম আত্মবিশ্বাস নিয়ে বাংলাদেশের কোন পেসার সর্বশেষ কবে বল করেছেন এটা খুঁজে বের করতেও হয়তো অনেক পিছনে ফিরে যেতে হবে।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে শ্রীলঙ্কার মাটিতে দুই ম্যাচের টেস্ট সিরিজে একদম ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে গতির সাথে বোলিং বৈচিত্র্যে ব্যাটসম্যানদের যে ভাবে আক্রমণ করেছেন, ধারাবাহিক বোলিংয়ে যে ভাবে প্রাণ ধরে রেখেছেন। প্রতিকূল কন্ডিশনেও যে ভাবে নিজের কাজটা সিদ্ধহস্তে করে দেখিয়েছেন। তাতে এই তাসকিন অন্যন্য, এই তাসকিন অসাধারণ।

শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে ভালো করার পর দেশের মাটিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তৃতীয় ওয়ানডেতেও এই পেসার শিকার করেছিলেন চার উইকেট। এরপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একমাত্র টেস্টে বল হাতে দাপট দেখানোর পর ওয়ানডে সিরিজেও ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছিলেন তিনি।

তাঁর বলে এই সময় যত গুলো ক্যাচ মিস হয়েছে এর আংশিকও যদি সতীর্থরা ধরতে পারতো তাহলে তাসকিনের পরিসংখ্যান হয়তো আরো একটু উজ্জ্বল হতো। কিন্তু সেরা ছন্দে থাকার পরেও টিম কম্বিনেশনের কারণে এই সময়ে খেলা ১৩ টি টি-টোয়েন্টির ভিতর মাত্র তিন ম্যাচে একাদশে সুযোগ পেয়েছিলেন তিনি।

দুঃসহ সময় পার করে নতুন মোড়কে ফেরা এই পেসার টি-টোয়েন্টিতে পর্যাপ্ত সুযোগ পেলে এই ফরম্যাটেও হয়তো নিজকে প্রমাণ করতে পারতেন। তবে ম্যাচ খেলার সুযোগ না পেলেও টিম ম্যানেজমেন্টের আস্থা তাঁর উপর থেকে একটুও কমেনি। আসন্ন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পেস বিভাগের অন্যতম সেরা অস্ত্র তিনি।

তাসকিনও এই আস্থার প্রতিদান দিতে বদ্ধ পরিকর। বিশ্বকাপ খেলতে দেশ ছাড়ার আগে মিরপুরে মাশরাফি বিন মর্তুজাকে ডেকে এনে তাঁর ক্লাসে হাজির হয়েছিলেন তিনি। নিজের ভান্ডারে নতুন কিছু অস্ত্র যোগ করাই ছিল মূল উদ্দেশ্যে। তাসকিন তাঁর ভান্ডারে নতুন অস্ত্র যোগ করতে পেরেছেন কিনা এটা এখনো নিশ্চিত নয়।

তবে তাঁর মূল অস্ত্র গতি দিয়েই এই বিশ্বকাপে হতে পারেন দারুণ কার্যকরি। এটাই তাঁর বোলিংয়ের প্রধান শক্তির দিক। আর দূর্বলতার জায়গা বলতে হঠাৎ করেই লাইন লেন্থ হারিয়ে ফেলা। এই জায়গাটাতে তাসকিন নিজকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে বিশ্বকাপ তাকে দুই হাত ভরেই দেবে হয়তো।

অস্বস্তিকর স্মৃতি সরিয়ে নতুন রোমাঞ্চ হয়তো দোলা দিচ্ছে তাসকিনকেও। নিজকে ভেঙে নতুন করে তৈরি করা তাসকিন বিশ্বকাপের মঞ্চে কেমন করবেন এটা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তবে তাসকিনের পক্ষে বাজি ধরার লোকই হয়তো বেশি। বাকিটা সময়ের হাতেই ছেড়ে দেওয়া যাক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link