আপনার আশেপাশে হৃদরোগের সমস্যায় ভুগছেন এমন মানুষ খুঁজে না পাওয়া দুষ্কর। একটু বয়স্ক যে কারো মধ্যেই হৃদপিন্ডের নানারকম রোগের দেখা মিলবে একটু খোঁজ করলেই। কিন্তু হৃদরোগ যে কারো হতে পারে। জীবনের যেকোন সময়ে দেখা দিতে পারে এই রোগের।
ফুটবল অঙ্গণে এই হৃদরোগের থাবা এসেছে বহুবার। ভক্ত সমর্থকদের কাঁদিয়ে খেলোয়াড়েরা বিদায় নিয়েছে ফুটবলের সবুজ গালিচা থেকে কিংবা নানারঙে রাঙা রঙিন জীবন থেকে। ফেব্রিস মুয়াম্বা, ইকার ক্যাসিয়াস নিয়েছেন ফুটবল থেকে। নিজের জীবনটাও হারিয়েছেন মার্ক ভিভিয়েন ফো, মিকলোস ফেহের সহ আরো বেশকিছু খেলোয়াড়।
সাম্প্রতিক সবথেকে আলোচিত এমন হৃদয়বিদারক ঘটনা ক্রিশ্চিয়ান এরিকসনের মাঠের মাঝে মুখ থুবড়ে পড়া। গত জুনে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশীপের নকআউট পর্বের এক ম্যাচে হৃদরোগ আক্রান্ত হয়ে জ্ঞান হারান খেলার মাঝপথেই। এইতো গেলো কিছুদিন আগে বার্সেলোনা স্ট্রাইকার সার্জিও অ্যাগুয়েরো মাঠ ছেড়েছেন কিছুটা অস্বস্তি নিয়ে। পরে জানা যায় তাঁর হৃদপিণ্ড জনিত কারণে মাঠের বাইরে থাকতে হবে মাস তিনেক।
এসকল ঘটনা নতুন না। তবে আবার জনমানুষের মনে প্রশ্ন জেগেছে ফুটবলারাও কি না ভোগেন হৃদরোগে? যারা কি না সারাদিন থাকেন কঠোর ডায়েটে তাঁর সাথে কতশত শারীরিক কসরত। তবুও তাঁরা কেন ভুগেন হৃদরোগে? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গোল.কম যোগাযোগ করেছিলেন ডাক্তার প্রফেসর রঞ্জন শেঠির সাথে। রঞ্জন শেঠি ভারতের বেঙ্গালুরে অবস্থিত মনিপাল হাসপাতালের কার্ডিলজি বিভাগ প্রধান হিসেবে দায়িত্বরত রয়েছেন।
ফুটবল খেলোয়াড়রা কেন আক্রান্ত হন হৃদরোগে এমন প্রশ্নের প্রতিউত্তরে প্রফেসর রঞ্জন জানান যে কারোর হৃদরোগে আক্রন্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। এর সাথে যুক্ত করে তিনি আরো বলেন, ‘দুই ধরণের রোগের দিকে আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে। প্রথমটা হাইপারকার্ডিও মায়োপ্যাথি (এইচসিএম) আর দ্বিতীয়টি পালমোনারি ব্লকেজ।’
এইচসিএম যেকোন বয়সের মানুষের হতে পারে। প্রায় ৫০০ জনের মধ্যে থেকে এক জনের এই ধরণের হৃদরোগ দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটা জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে। সাধারণত হৃদপিন্ডের পেশিগুলো মোটা হয়ে যাওয়ার মত পরিস্থিতিকেই এইচসিএম নামকরণ করা হয়েছে। সচারচর তরুণদের ক্ষেত্রে এই ঘটনাটা বেশি চোখে পড়ে। তাছাড়া অধিকাংশ মানুষে এই ধরণের হৃদরোগ বড় কোন সমস্যার সৃষ্টি করে না। ঠিক এমনটাই জানান ডাক্তার রঞ্জন শেঠি হাইপারকার্ডিও মায়োপ্যাথি ব্যপারে।
তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণত ৩৫ উর্ধ্ব ব্যক্তিদের হার্ট অ্যাটাক হয়ে থাকে ব্লকেজের কারণে। যদিও খেলোয়াড়েরা নিয়মিত শরীর চর্চা করে থাকেন এবং একটি নির্দিষ্ট ডায়েট মেনে চলেন, তবুও তাঁদের ব্লকেজ দেখা দিতে পারে। এর পেছনে সবচেয়ে বড় নিয়ামক হিসেবে কাজ করে পারিবারিক ইতিহাস এবং উচ্চ কোলেস্টেরল মাত্রা।’
প্রফেসর রঞ্জনের মতে হার্ট অ্যাটাক ভুমিকম্পের মত। যে কারো জীবনে যে কোন সময় হাজির হয়ে যেতে পারে এই মরণঘাতি হৃদপিণ্ড জনিত সমস্যা। এইচসিএমের ক্ষেত্রে পূর্বে টেস্ট ছাড়া বিকল্প কোন পথ নেই। ফুটবলারদের নিয়মিত পরীক্ষানিরীক্ষা করার পরামর্শ দেন প্রফেসর রঞ্জন শেঠি। তিনি আরো পরামর্শ দেন প্রতিটি ফুটবলারদের উচিৎ তাঁর ফুটবলীয় ক্যারিয়ার শুরুর পূর্বে অন্ততপক্ষে ইলেক্টোকার্ডিওগ্রাম ও ইকোকার্ডিওগ্রাম করিয়ে নেওয়া। যদি পরিবারে ইতিহাসে হার্ট অ্যাটাকের মত ঘটনা ঘটে থাকে তাহলে যে কোন বয়সের মানুষের এই দু’টি টেস্ট করে নেওয়া একপ্রকার বাধ্যতামূলক বলেই আখ্যায়িত করেন প্রফেসর রঞ্জন।
তাছাড়া আরো ভিন্ন ধর্মী সব হৃদরোগ থেকে পরিত্রাণ পেতে ডাক্তার রঞ্জন খেলোয়াড়দের লাইফস্টাইলের দিকে নজর দিতে এবং সংযত থাকতে পরামর্শ দেন। এছাড়াও তিনি বলেন, ‘ফুটবলাররা বেশ ভালভাবেই শারীরিক ব্যায়াম করে থাকেন, তবে অতিরিক্ত শারীরিক কসরত কোন প্রকার ট্রেনিং ছাড়াও বিভিন্ন ধরণের সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে। মাঝেমাঝে অনেকে ভুলে যান যে এই বিষয়টা। অতিরিক্ত ব্যায়াম হৃদপিণ্ডের পেশিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তাই বেশি ব্যায়াম করা থেকেও বিরত থাকতে হবে। আর সর্বোপরী নিয়মতান্ত্রিক ব্যায়ামের পাশাপাশি ওয়ার্মআপ ও কুল ডাউনও সমান গুরুত্বপূর্ণ।’
প্রফেসর রঞ্জন এমআরআই টেস্ট করিয়ে নিতেও পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি বেশ জোড় দিয়েই জানিয়েছেন খেলোয়াড়দেরকে তাঁদের শারীরিক সকল ধরণের পরীক্ষা শেষেই পেশাদার ক্যারিয়ার শুরু করা উচিৎ। এমনটা এখন ইউরোপিয় ফুটবল থেকে শুরু করে উপমহাদেশেও ব্যাপকভাবে অনুকরণ করা হচ্ছে।
কিন্তু আসলে হৃদরোগ যে কারোই হতে পারে। একজন খেলোয়াড় থেকে সারাদিন খেটে যাওয়া একদিন দিনমজুরের। তাই এই রোগ থেকে বেঁচে থাকতে হলে নিয়মমাফিক জীবনযাপনের বিকল্প নেই। হাজার সতর্ক থাকলেও কোন একদিন হঠাৎ ভূমিকম্পের মতো করে হানা দিতে পারে হার্ট অ্যাটাক। সেদিন অবধি নিজেকে থাকতে হবে সাবধান এবং সৃষ্টিকর্তার কাছে করে যেতে হবে প্রার্থণা। ফুটবলাররাও মানুষ এবং মানুষ নশ্বর!