‘রিমেম্বার দ্যা নেইম’- মনে পড়ে এ উক্তিটি? খুব বেশি ভুলোমন না হলে অবশ্য মনে না পড়ার কারণও নেই। পাঁচ বছর আগের স্মৃতি আর কতই বা পুরনো হবে। ম্যাচের শেষ ওভারে টানা চার বলে অবিশ্বাস্যভাবে চারটি ছয় হাঁকানো, বেন স্টোকসের মুখ লুকানো, আর ধারাভাষ্য কক্ষ থেকে ইয়ান বিশপের বজ্র কন্ঠ, ‘কার্লোস ব্রাথওয়েট, রিমেম্বার দ্যা নেইম’ – অন্তত বিশ্বকাপের এ সময়ে স্মৃতিতে ফিরে আসতে বাধ্য।
টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সাফল্যের মূল অস্ত্র পাওয়ার হিটিং, যা ক্যারিবীয়দের শক্তির মূল জায়গাও বটে। যে কারণে বিশ্বব্যাপী ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগগুলোর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বৈশ্বিক আসরগুলোতেও উইন্ডিজ ক্রিকেটারদের ওপর থাকে আলাদা নজর। গত তিন বিশ্বকাপে একটিতে সেমি ও বাকি দুটোতে ফাইনাল খেলেছে দলটি,যেখানে দুটি থেকেই ফিরেছে ট্রফি হাতে।
এর মাধ্যমে এখনও পর্যন্ত অনুষ্ঠিত ছয়টি বিশ্বকাপে ট্রফি জয়ের দিক দিয়ে অন্য সব দলকে ছাড়িয়ে গেছে তাঁরা। সাম্প্রতিক সময়ে টেস্ট- ওডিআইতে অবস্থান আর যা-ই হোক, অন্তত টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তাঁদের টপ ফেভারিট মানতেই হবে। ক্রিকেটের সংক্ষিপ্ততম এই সংস্করণকে নিজেদের নামের এক প্রকার প্রতিশব্দই যে বানিয়ে নিয়েছে ক্যারিবীয়রা!
২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশের কাছে হেরে গ্রুপ পর্ব থেকেই বাদ পড়ে তাঁরা। পরের বিশ্বকাপে অবশ্য ঘুরে দাঁড়িয়েছিল। সুপার এইটে হট ফেভারিট ইংল্যান্ড ও সে সময়কার ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন ভারতকে ডিঙিয়ে সেমিতে উঠে আসে উইন্ডিজরা। তবে ২০১০ বিশ্বকাপে স্বাগতিক হয়েও তেমন আহামরি কিছু করতে পারে নি তাঁরা। মূল গ্রুপে প্রথম হয়ে সুপার এইটে ওঠা ক্যারিবীয়দের গ্রুপে তৃতীয় হয়ে শেষ করতে হয়েছিল সেবারের আসর।
আর তার ঝাল মেটাতেই কিনা পরের বিশ্বকাপকে উপযুক্ত মঞ্চ হিসেবে ঠিক করে নিয়েছিল তাঁরা। লংকানদের মাটিতে অনুষ্ঠিত সেবারের আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিরেছিল তাঁরা। এক্ষেত্রে অবশ্য ভাগ্যের সহায়ও পেয়েছিল কিছুটা। গ্রুপ পর্ব পার হতে যেখানে অন্তত এক ম্যাচ জয়ের দরকার ছিল উইন্ডিজদের, সেখানে কোনো জয় ছাড়াই পরের পর্বে উত্তীর্ণ হয়েছিল তাঁরা! অজিদের কাছে প্রথম ম্যাচে হারের ফলে আইরিশদের বিপক্ষে ম্যাচটি ‘বাঁচা-মরার লড়াই’ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তাঁদের জন্য।
পরে বৃষ্টির বাগড়ায় ম্যাচটি পরিত্যাক্ত হওয়ায় পয়েন্ট ভাগ করে নেয় দু দল। আর তাতে নেট রানরেটের হিসেবে সুপার এইটের টিকিট পায় উইন্ডিজরা। আবার সুপার এইটে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গুরুত্বপূর্ণ জয়টাও এসেছিল নাটকীয়তার মাধ্যমে। কিউইদের ১৩৯ রানে বেঁধে ফেলে নিজেরাও আটকে যায় সেই ১৩৯ রানে, যার কারণে সুপার ওভারে গড়িয়েছিল ম্যাচটি। শেষ বলে ক্রিস গেইলের ছয়ে সে ম্যাচে বিদায় ঘণ্টা বেজেছিল কিউইদের, আর সেমিতে যাওয়ার পথে টিকে থাকে উইন্ডিজরা। পরে সেমিতে অজিদের ও ফাইনালে স্বাগতিকদের উড়িয়ে প্রথমবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ট্রফি হাতে নেয় তাঁরা।
বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ২০১৪ বিশ্বকাপে গ্রুপ রানারআপ হয়ে সেমিতে ওঠে তাঁরা। আগেরবার যাঁদের হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, সেমিতে সে লংকানদেরই মোকাবেলা করতে হয়েছিল উইন্ডিজদের। ডিএল মেথডে ২৭ রানে হেরে সেই সেমিতেই শেষ হয় তাঁদের সেবারের বিশ্বকাপ যাত্রা। তার দু বছর পর ভারতের মাটিতে সেই খোয়ানো ট্রফি ফিরিয়ে আনে ক্যারিবীয়রা। ইংল্যান্ড, দক্ষিণ আফ্রিকাকে টপকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হয়ে সেমিফাইনালে হারায় শক্তিশালী ভারতকে। আর ফাইনালে ইংলিশদের বিপক্ষে রোমাঞ্চকর জয়ের সেই স্মৃতি তো এখনও তরতাজা।
উইন্ডিজ ক্রিকেটের এই নড়বড়ে অবস্থায় এমন ট্রফি জয় বিশেষ কিছু ছিল তাঁদের জন্য। ক্রিকেট বোর্ডের সাথে ক্রিকেটারদের বনিবনার অভাব, আর্থিক অসঙ্গতিসহ আরও বেশ কিছু সমস্যায় জর্জরিত হয়ে পড়েছিল একসময়ে ক্রিকেট বিশ্বে দাপিয়ে বেড়ানো এই দলের ক্রিকেটাঙ্গন। দলের ভেতরকার এসব সমস্যার সাথে যোগ হয়েছিল অনেকের কটূক্তি। অজি ধারাভাষ্যকার মার্ক নিকোলাস তো একবার মেধাহীন দলের ট্যাগই লাগিয়ে দিয়েছিলেন তাঁদের গায়ে!
আর এই সব সমালোচনার উপযুক্ত জবাব দিতে মুখিয়ে ছিল পুরো দল, যার প্রতিফলন তাঁরা দেখিয়েছিলেন মাঠে। টি-টোয়েন্টিতে ক্যারিবীয়দের উত্থানের এ সময়ে যিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, সে ড্যারেন সামিই নিজেদের মনে জমে থাকা আক্ষেপ, অভিমান আর ক্ষোভের কথা অকপটে ঝেড়েছিলেন সে দিন ম্যাচ শেষে, ‘আমরা এমন একটা সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলাম যখন বিশ্বকাপ খেলতে পারব কিনা তা নিয়েই মানুষ সন্দিহান ছিল। আমাদের অনেক সমস্যা ছিল- ক্রিকেট বোর্ডের কাছ থেকে যথাযথ সম্মান পাই নি, মার্ক নিকোলাস আমাদের বুদ্ধিহীন দলের তকমা দিয়েছিলেন। আসর শুরুর আগে এসব ব্যাপার প্রকৃতপক্ষে আমাদের একত্রিত করেছিল।’
সব প্রতিকূলতার মুখেও দলের এমন অসাধারণ পারফরম্যান্সে দলের সদস্যদের কৃতিত্ব দিতেও ভোলেন নি তিনি, ‘সকল প্রতিকূলতাকে পাশ কাটিয়ে মাঠে দর্শকদের সামনে যে এ ধরনের ক্রিকেট খেলার সামর্থ্য দেখিয়েছে, তাঁর জন্য আমি আমার স্কোয়াডের এই ১৫ জনকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। এটি আসলেই অসাধারণ।’
আর সেই সুখস্মৃতি নিয়ে এবার আরও একটি বিশ্বকাপের মঞ্চে এসেছিলেন পোলার্ডরা। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বেলায় গেইল-ব্রাভোরা উপহার দিতে চেয়েছিলেন আরও একটি ট্রফি। কিন্তু আসরের প্রথম ম্যাচে নিজেদের বিবর্ণ চেহারা দেখিয়েছিলেন তাঁরা। নিজেদের ব্যাটিং ব্যর্থতায় মাত্র ৫৫ রানে অলআউট হয়ে ইংলিশদের কাছে ম্যাচটা তাঁরা হারে ৭০ বল বাকি থাকতে। আসরের বাকি অংশে শুরুর সে ধাক্কা আর কাটিয়ে উঠতে পারেনি ক্যারিবীয়রা।
বাংলাদেশের বিপক্ষে একমাত্র জয় নিয়েই এবারের আসর শেষ করতে হয়েছে তাঁদের। টি-টোয়েন্টিতে তাঁদের শক্তির মূল জায়গা হিসেবে পরিচিত ব্যাটিং বিভাগ, আর সেখানেই ফেল করেছেন উইন্ডিজ ব্যাটাররা। পুরো আসর জুড়ে নিষ্প্রভ ছিলেন গেইল-রাসেলরা। নিকোলাস পুরান ছাড়া আর কেউই তেমন জ্বলে উঠতে পারেননি এবারের আসরে, যার খেসারত দিতে হয়েছে গ্রুপ পর্ব থেকে বাদ পড়ে।
বছর না ঘুরতেই আরেকটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এসে পড়বে। দর্শকরা আবারও তাকিয়ে থাকবেন ক্যারিবীয়দের সেই মারকাটারি ব্যাটিংয়ের দিকে। ইতোমধ্যেই অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন ড্যারেন ব্রাভো, ক্যারিয়ারের শেষ দিকে এসে পড়েছেন ‘ইউনিভার্স বস’ও। কিন্তু তাতে কি! এবার তাঁদের অনুপস্থিতিতে সবাই তাকিয়ে থাকবেন হেটমায়ার-পুরানদের দিকে। গেইল-ব্রাভোদের শূন্যতা এই তরুণেরা কতটুকু পূরণ করতে পারবেন তা-ই এখন দেখার বিষয়।