অ্যারন ফিঞ্চ, গ্লাভস ছেড়ে মারকুটে ওপেনার

কেবিনেটে পাঁচটি ট্রফি। তবুও একটা আক্ষেপ, একটা শূন্যস্থান। সেটি পূরণ করতে প্রয়োজন একটি টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ। রিকি পন্টিং, মাইকেল ক্লার্ক, জর্জ বেইলি, স্টিভ স্মিথরা যা পারেননি সেই অধরা স্বপ্ন পূরণ করেছেন অ্যারন ফিঞ্চ। ফিঞ্চের হাত ধরেই অজিদের শিরোপা কেবিনেটে যুক্ত হলো টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ট্রফি।

অধিনায়ক হিসেবে যাত্রাটাও তো তিন বছরের।

২০১৮ সালটা ছিল অজিদের জন্য যেন এক কলঙ্কিত বছর। কেপটাউনে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টেস্টে ‘স্যান্ডপেপার’ কাণ্ডে নিষিদ্ধ হন সে সময়ের অজি অধিনায়ক স্টিভ স্মিথ ও সহ-অধিনায়ক ডেভিড ওয়ার্নার। রঙিন পোশাকে নতুন অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেলেন অ্যারন ফিঞ্চ।

তীব্র সমালোচনা আর বিদ্রুপের মাঝেই দলের বোঝা কাঁধে নেন ফিঞ্চ। পরের বছর ইংল্যান্ডের মাটিতে বিশ্বকাপ! সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে হেরে টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয় থেকে বঞ্চিত হয় অজিরা। তবে দায়িত্ব পাওয়ার এক বছরের মাথায় ফিঞ্চের অধীনে দলের সাফল্যটা ছিল বেশ নজর কাড়া।

এরপরই যেন হঠাৎ খেই হারিয়ে ফেলেছিল একসময় ক্রিকেট দুনিয়া ত্রাশ করা অস্ট্রেলিয়া। রঙিন পোশাকে সময়টা মোটেও ভাল যাচ্ছিল না অজিদের। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগেও টানা পাঁচ টি-টোয়েন্টি সিরিজ হার। বিশ্বকাপে অজিদের নিয়ে প্রত্যাশার পারদটাও ছিল একেবারেই তলানিতে। কিন্তু ফিঞ্চের বিশ্বাস ছিল তিনি পারবেন। সেই বিশ্বাস থেকেই হারের বৃত্তে থাকা দলকে নেতৃত্ব দিয়ে ঠিক শিরোপা নিজেদের করে নিল অজিরা।

প্রথম অজি অধিনায়ক হিসেবে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ শিরোপা জেতেন ফিঞ্চ। অজিদের ট্রফির কেবিনেটে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের সেই খালি জায়গাটা ভরাট হল অ্যারন ফিঞ্চের হাত ধরেই।

কল্যাক ওয়েস্ট ক্রিকেট ক্লাবের হয়ে খেলতেন বয়স ভিত্তিক দলে। সেখান থেকে পাওয়ার হিটিং আর ব্যাটিং সামর্থ্যের কারণে ২০০৬ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে সুযোগ পান ফিঞ্চ। একই দলে খেলেছিলেন ডেভিড ওয়ার্নার, উসমান খাজারাও। এরপর সেখান থেকে ২০০৮ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ভিক্টোরিয়ার হয়ে খেলার সুযোগ পান তিনি। ক্যারিয়ারের শুরুতে ফিঞ্চ ছিলেন একজন উইকেটকিপার ব্যাটার। ব্যাটিংটাও করতেন লোয়ার-মিডল অর্ডারে। অবশ্য পরবর্তীতে কিপিং ছেড়ে পুরোপুরি মনযোগী হন ব্যাটিংয়েই।

প্রথম শ্রেণির অভিষেক ম্যাচটা খেলেছিলেন অভিষেকে ভারতের বিপক্ষে। অজিদের বিপক্ষে বক্সিং ডে টেস্টকে সামনে রেখে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলে ভারত। বৃষ্টি-বিঘ্নিত ওই ম্যাচে মোটে খেলা হয় ৪৮ ওভার; যার পুরোটাই ভার‍ত ব্যাট করে। যার কারণে অভিষেক প্রথম শ্রেণির ম্যাচে ব্যাটিং কিংবা বোলিং কোনো ভূমিকাতেই দেখা যায়নি ফিঞ্চকে।

এরপর ২০০৯ সালে ভিক্টোরিয়ার হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে মেইডেন সেঞ্চুরির দেখা পান ফিঞ্চ। সেবার ভিক্টোরিয়ার হয়ে দুর্দান্ত এক মৌসুম পার করে দল পান ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল)। ২০১০ মৌসুমে রাজস্থান রয়্যালসে সুযোগ পেলেও সেবার মাত্র ১ ম্যাচের বেশি খেলার সুযোগ পাননি এই ব্যাটার।

এরপর চ্যাম্পিয়নস লিগে ফিঞ্চের মারকাটারি ব্যাটিং তাঁকে সুযোগ করে দেয় ২০১১ আইপিএলেও। ওই বছর আইপিএলে ৬ ম্যাচে সুযোগ পেলেও দেখাতে পারেননি নজরকাড়া ইনিংস। তবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তাঁর পারফরম্যান্স আর পাওয়ার হিটিং অ্যাবিলিটি তাঁকে সুযোগ করে দেয় জাতীয় দলে।

২০১১ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে ফিনিশার হিসেবেই ডাক পেলেন তিনি। অভিষেক ম্যাচে অপরাজিত ১৫ রানের ইনিংসের পর দ্বিতীয় ম্যাচেই খেলেন ৩৩ বলে অপরাজিত ৫৩ রানের এক ঝড়ো ইনিংস। নিজের খেলা দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক ম্যাচেই জিতলেন ম্যাচ সেরার পুরষ্কার। ফিঞ্চের ওই ইনিংসে জয় নিয়ে সিরিজ সমতায় আনে অজিরা।

কিন্তু পরের দুই টি-টোয়েন্টি সিরিজে স্কোয়াডে থাকলেও একাদশে আর সুযোগ পেলেন না ফিঞ্চ! শ্রীলঙ্কা ও দক্ষিণ আফ্রিকার মাটিতে দলের সাথে সফর সঙ্গী হলেও টিম কম্বিনেশনের কারণে দুর্দান্ত এক ফিফটির পরেও নিজের জায়গায় খুঁজে পাননি একাদশে। এর প্রায় এক বছর পর ঘরের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি সিরিজে আবার একাদশে সুযোগ পেলেন তিনি। ভারতের বিপক্ষে এক ম্যাচে ২৩ বলে ৩৬ রানের গুরুত্বপূর্ণ এক ইনিংস খেললেও আবারও বাদ পড়েন ফিঞ্চ!

অনবদ্য পারফরম্যান্সের পরেও এত এত তারকাদের ভীড়ে একাদশে ঠাঁই মেলেনি ফিঞ্চের। দলে আসা-যাওয়ার গল্পটাও এখানেই শেষ। অধারাবাহিকতার খাতায় ইতি টেনে ফিঞ্চের ক্যারিয়ার মোড় নেয় এক ভিন্ন রূপে।

২০১৩ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডেতে অভিষিক্ত হন ফিঞ্চ। টি-টোয়েন্টিতে লোয়ার অর্ডারে খেললেও ওয়ানডেতে সুযোগ পেয়েছিলেন ওপেনার হিসেবেই। তবে ওয়ানডেতে শুরুর দিকে নিজেকে ঠিকঠাক মেলে ধরতে পারেননি তিনি। টি-টোয়েন্টিতে দলে ফিরলেও টানা বেশ কয়েক ম্যাচেই দেখান চরম বাজে পারফরম্যান্স।

তবে রঙিন পোশাকে অজিদের হয়ে ওপেনিংয়ে তখন তিনি প্রায় নিয়মিত হয়ে উঠছিলেন। এরপর ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেললেন রেকর্ড গড়া ইনিংস। ৬৩ বলে ১৫৬ রানের ইনিংসের পথে আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ইতিহাসে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ড গড়েন ফিঞ্চ।

আগ্রাসী ব্যাটিংয়ে পাওয়ার প্লে কাজে লাগিয়ে ওপেনিংয়ে দারুণ শুরু এনে দিতেন ফিঞ্চ। রঙিন পোশাকে হয়ে উঠলেন দলের নিয়মিত মুখ। ওই বছরই স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে ১৪৮ রানের ইনিংসের পথে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের মেইডেন সেঞ্চুরি করেন ফিঞ্চ। মারকাটারি ব্যাটিংয়ে বার বার মুগ্ধ করেছেন সবাইকে।

২০১৫ বিশ্বকাপের স্কোয়াডেও ছিলেন নিয়মিত মুখ। সেবার নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে অজিদের হয়ে প্রথমবার শিরোপা জয়ের স্বাদ পান এই অজি ওপেনার। নিজের খেলা প্রথম বিশ্বকাপের অভিষেক ম্যাচ খেলতে নেমেই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন ১৩৫ রানের ম্যাচ জয়ী এক ইনিংস। বিশ্বকাপে অভিষেক ম্যাচেই নির্বাচিত হন ম্যাচ সেরা। ওই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ভারতের বিপক্ষে ৮১ রানের অসাধারণ এক ইনিংসও খেলেন তিনি।

এরপর ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টি-টোয়েন্টিতে নিজের রেকর্ড ভেঙে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রানের নতুন রেকর্ড গড়েন এই অজি ওপেনার। খেলেন ৭৬ বলে ১৭২ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। একমাত্র ব্যাটার হিসেবে টি-টোয়েন্টিতে দুইবার দেড়শো রানের রেকর্ডটিও ফিঞ্চের ঝুলিতেই আছে।

ওই বছরই স্যান্ডপেপার কাণ্ডে ওয়ার্নার-স্মিথরা নিষেধাজ্ঞা পাওয়ায় সাদা পোশাকে অভিষিক্ত হন তিনি। পাকিস্তানের বিপক্ষে অভিষেক টেস্টের প্রথম ইনিংসেই করেছিলেন ফিফটি। দ্বিতীয় ইনিংসে অবশ্য এক রানের জন্য আরেকটি হাফ-সেঞ্চুরি মিস করেন তিনি।

পরের চার টেস্টে মাত্র এক ফিফটি করেছিলেন এই অজি ওপেনার। এর পরই সাদা পোশাকে বাদ পড়লেন। পাঁচ টেস্টের সংক্ষিপ্ত টেস্ট যাত্রার ইতিটা ঘটে ভারতের বিপক্ষে। এরপর আর সুযোগও পাননি এই ফরম্যাটে।

তবে কলঙ্কের দাগ লেগে থাকা সেই হলুদ জার্সির দায়িত্ব নিয়ে দলকে স্বপ্ন দেখিয়েছেন আরেকবার উঠে দাঁড়াবার। ২০১৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে হোঁচট খেলেও ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অজিদের সেই টি-টোয়েন্টি শিরোপা জয়ের খরা কাটালেন ফিঞ্চ।

অধারাবাহিক আর অনিয়মিত মুখ থেকে দলের গুরুদায়িত্বটা এখন ফিঞ্চের কাঁধে। এক সময় উইকেটের পেছনে গ্লাভস হাতে থাকা লোয়ার অর্ডারের সেই ফিঞ্চ কিনা বনে গেলেন মারকুটে এক ওপেনার! সেখান থেকে বনেছেন বিশ্বকাপজয়ী অধিনায়ক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link