লিটন ‘দ্য ব্যাটিং পিকাসো’

লিটন যখন বাইশগজে তখন মুগ্ধনয়নে দেখতে হয় তাঁর ব্যাটিং। কারণ, লিটন উইকেটে থাকা মানেই দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ের চরম নিশ্চয়তা। সৌন্দর্য, নান্দনিকতা, চোখ ও মনকে প্রশান্তি দেওয়া। লিটনের ইনিংস মানেই চোখে লেগে থাকা ঘোর। প্রায়শঃ এমনসব স্ট্রোকের ফুলঝুড়ি দেখা যায় যা বারবার দেখার ইচ্ছে জাগে!

কিন্তু, সমস্যা হলো স্ট্রোকের এমন ফুলঝুড়ি নিয়মিত নয়, দেখা যায় কালেভদ্রে। যদিও ইদানিং দিচ্ছেন ধারাবাহিক হওয়ার প্রতিশ্রুতি। ২০১৫ সালে মাশরাফি বিন মর্তুজার নেতৃত্বেই ওয়ানডে অভিষেক হয়েছিল লিটন দাসের। এই ফরম্যাটে ক্যারিয়ারের পুরোটা সময় মাশরাফির নেতৃত্বেই খেলেছেন। লিটনের ব্যাটিং বরাবরই চোখের প্রশস্তি বাড়িয়ে দেয়।

মাশরাফিকে সেটা দেয় কয়েকগুন। এমনি এমনি তো মাশরাফি লিটনের চরম ভক্ত নন। তাঁর কাছে দৃষ্টিসুখকর ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি দুটো নাম- বিরাট কোহলি আর লিটন দাস। মাশরাফির মত লিটনের ব্যাটিং এর ভক্ত বাংলাদেশের সব কোচিং স্টাফ এবং প্রায় সকল খেলোয়াড়।

বিকেএসপিতে ভর্তির পর থেকেই দুর্দান্ত সব শট ও রান ফোয়ারার কারনে স্কুল এবং বয়সভিত্তিক সব দলে সহজেই সকলের চোখে পড়েন লিটন। একে একে খেলেছেন অনূর্ধ্ব-১৫, অনূর্ধ্ব-১৭, এবং অনূর্ধ্ব-১৯ দলে। বলাই বাহুল্য, দুর্দান্ত সব ইনিংসে অনায়াসেই নিজের পরিচিতি বাড়িয়ে নিয়েছেন বহুগুণে।

পাশাপাশি উইকেটের পেছনে দক্ষতাও ছিল বলার মতো। খেলেছেন ২০১২ ও ২০১৪ সালের দুটি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে। যদিও তার আগেই ২০১১ সালে হয় প্রথম শ্রেনির ক্রিকেটে অভিষেক এবং ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের আগেই পেয়ে যান প্রথম শ্রেনির ক্রিকেটে প্রথম সেঞ্চুরি। অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ৬ ম্যাচ খেলে ১ সেঞ্চুরি ও ২ হাফ সেঞ্চুরিসহ ২৬২ রান করেন, পুরো টুর্নামেন্টে ছায়া হয়ে থাকেন এনামুল হক বিজয়ের দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের কারনে। ২০১৪ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে ৪ ইনিংসে করেন ২৩৯ রান।

এরপর ২০১৪-১৫ মৌসুমের ঢাকা প্রিমিয়ার লিগে করেন তাক লাগানো পারফরম্যান্স, হলেন লীগের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানসংগ্রাহক, ১ সেঞ্চুরি ও ৫ হাফ সেঞ্চুরিতে করলেন ৬৮৬ রান। উইকেটের পেছনেও ছিলেন দারুণ উজ্জ্বল। ১৬ ম্যাচে ২২ ক্যাচ ও ৭ স্ট্যাম্পিং করে হলেন ডিপিএলের সেরা উইকেটরক্ষক। তখনই নির্বাচকদের নজর কেড়ে নিয়েছিলেন তার ব্যাটিং সোন্দর্য দিয়ে। এই ফর্ম ধরে রাখলেন জাতীয় ক্রিকেট লিগেও, লিটন করলেন এক মৌসুমের সর্বোচ্চ পাঁচ শতক (আগের রেকর্ড ৪ শতক) আর রান?

৮৫ গড়ে ১০২৪, যা ভেঙে দিলো ১৩ বছরের পুরনো রেকর্ড (আগের রেকর্ড ১০১২, মিনহাজুল আবেদিন নান্নুর)। এমন পারফরম্যান্সের পর কোচ হাতুড়েসিংহের বিশেষ নজরে পড়েছিলেন, পেয়েছিলেন ২০১৫ বিশ্বকাপের ৩০ জনের প্রাথমিক স্কোয়াডে সুযোগ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জায়গা হয়নি বিশ্বকাপের মুলদলে।

অবশেষে সুযোগটা এল সাদা পোশাকে, ২০১৫ সালে ভারতের বিপক্ষে অভিষেক হলো উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান লিটনের। ব্যাটিংয়ে নেমে দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ে মাত্র ৪৫ বলে করলেন ৪৪ রান, ভূয়সী প্রশংসা পেলেন ভারতীয় কমেন্টেটরদের। এরপর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও করেন আরেকটি অর্ধশতক, টেল-এন্ডারদের নিয়ে ব্যাটিংয়ের সামর্থ্য দেখালেন এক ঝলক। লিটনকে তখন দারুণ এক সংযোজন বলে মনে হচ্ছিল। অভিষেক হয়েছে ওয়ানডে এবং টি-টোয়েন্টিতে।

বিক্ষিপ্তভাবে ২/৩ টি ভালো ইনিংস খেলেছিলেন কিন্তু ধারাবাহিক হতে পারছিলেন না ব্যাটিং এ। তবে যতক্ষন থাকতেন ক্রিজে থাকতেন, খেলতেন নয়নাবিরাম সব ক্রিকেটীয় শট। ক্রিজে নেমেই করতেন তাড়াহুড়ো, খেলতেন অপ্রয়োজনীয় সব শট। লিটন দাস হাতে আছে প্রায় সবরকম শট। পুল, হুক, ফ্লিক, সুইপ (প্যাডল, স্লগ, রিভার্স), ফ্লিক, ড্রাইভ, কাট, আপার কাট, স্কুপ, ইনসাইড আউট।

বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে আর কোনো ব্যাটসম্যানের শট রেঞ্জ এতো বেশি আছে বলে মনে হয় না। এই শট রেঞ্জই কাল হয়ে দাড়াল লিটনের। তার স্কিল, সামর্থ্য নিয়ে কারোরই বোধহয় কখনো সংশয় ছিল না। লিটন দাসের ঘাটতি ছিল ধারাবাহিকতায়, তুখোড় প্রতিভা দিয়েও নিজেকে যেন নিতে পারছিলেন না অন্য ধাপে । অমিত সম্ভাবনাময়ী ক্রিকেটার হিসেবে তাকে গণ্য করা হয়। যতক্ষণ ক্রিজে থাকেন মনে হয় যেনো ব্যাট দিয়ে কবিতার ছন্দ লিখেন। কিন্তু ধারাবাহিকতার অভাবে প্রতিভার প্রকাশ আর হয়ে উঠেনি।

একের পর এক ব্যর্থতায় একাদশে নিয়মিত হতে পারছিলেন দলে কিন্তু ঘরোয়া লিগে চলছিলো লিটনের রানফোয়ারা। ২০১৮ নিদাহাস ট্রফিতে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে মাত্র ১৯ বলে ৪৩ রানের ইনিংসের মাধ্যমে জানান দিলেন নিজের ব্যাটিং এর ভয়াল সৌন্দর্যকে। এরপর ব্যাট হাতে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আবারও চিরচেনা অধারাবাহিক।

তবে বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের শক্ত অবস্থানের জানান দেন ২৮ সেপ্টেম্বর, ২০১৮। সাকিব-তামিমবিহীন বাংলাদেশ দুবাই আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে এশিয়া কাপের ফাইনালে মুখোমুখি শক্তিশালী ভারতের । টান টান উত্তেজনাপূর্ণ সেই ম্যাচে শেষ বলে বাংলাদেশ হারলেও পুরো ক্রিকেটবিশ্বকে চমকে দিয়েছিল লিটন। পাঁচবারের এশিয়া কাপ চ্যাম্পিয়ন ভারতের বোলারদের নাকানি-চুবানি খাইয়ে করেছিলেন ১১৭ বলে ১২১ রানের অনবদ্য জাদুকরি এক ইনিংস।

সেই ম্যাচে এতটাই অসহায় করে রেখেছিলেন ভারতের গোটা বোলিং অ্যাটাককে, বোলাররা বল ফেলার জায়গা পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছিল না। ফাইনালে বাংলাদেশ হারলেও ম্যাচ সেরার পুরষ্কারও জিতেছিলেন লিটন দাসই। ফাইনালের ওই ইনিংস এর পরেই তার নান্দনিক ব্যাটিং এর প্রেমে পড়েন অনেকেই! কি ছিলো না ১২১ রানের ইনিংসে?

লিটনের উইকেটে থাকা মানেই দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ের নিশ্চয়তা। ২০১৯ বিশ্বকাপে টন্টনে ওয়েস্টইন্ডিজের বিপক্ষে ৬৯ বলে অপরাজিত ৯৪ রান এখনো যেন চোখে লেগে আছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। ৪ ছক্কা ও ৮ চারের ওই ইনিংসের সাহায্যে ৩২২ রানের অসম্ভব প্রায় স্কোর তাড়া করে সেদিন জয় পায় বাংলাদেশ মাত্র ৪২ ওভারে।

তারপর জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ঘরের মাটিতে করলেন দুর্দান্ত এক সেঞ্চুরি। ১০৫ বলে ১২০ স্ট্রাইক রেটে ১৩ চার আর দুই ছক্কায় অপরাজিত ১২৬ রানের মন্ত্রমুগ্ধ ইনিংস খেলে লিটন যেন বোঝালেন, ওপেনারদের এভাবেই খেলতে হয়। ক্যারিয়ারের ৩৬ তম ইনিংসে ছাড়িয়ে গেলেন নিজেকে, খেলে ফেললেন বাংলাদেশের হয়ে সর্বোচ্চ ব্যাক্তিগত ১৭৬ রানের মহানান্দনিক এক ইনিংস। এমন ইনিংস বাংলাদেশ ক্রিকেট এর আগে দেখেনি। চোখজুড়ানো সৌন্দর্যের নান্দনিক সুন্দর ব্যাটিং।

প্রতিভা আছে, বড় ইনিংস খেলার ক্ষমতা আছে আর সবচেয়ে বড় কথা প্রতিপক্ষের বোলারদেরকে কঁচুকাটা করার নিষ্ঠুর ক্ষমতাটা লিটনের রয়েছে । লিটন খেলার মোমেন্টাম পরিবর্তন করতে পারে, উইকেটে থাকতে পারে, বড় ইনিংস খেলতে পারে- সবই পারে। অভিজ্ঞতাও এখন অর্জন হয়েছে লিটনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে। নিজের খেলাটা বুঝতে শুরু করেছেন লিটন। তবে কি লিটন পারবেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের কাণ্ডারি হতে?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link