একটা বিশ্ব রেকর্ড হবে, আগের ইতিহাসে কলমের আচড় পড়বে। লেখা হবে নতুন এক ইতিহাস। দরকার ১৯ বলে ১৬ রান। ক্রিকেটের অসাধ্য কিছু নয়। কিন্তু উইকেট তো বাকি কেবল দু’টি। আক্ষরিক অর্থে তিনটি কিন্তু একজন ইনজুরিতে। তাঁর থেকেও চিন্তার বিষয় খেলাটা হচ্ছে টেস্টের পঞ্চম দিনে। কিন্তু তাঁর থেকেও বেশি ভাবাচ্ছে প্রতিপক্ষ বোলাররা। বিশ্ব রেকর্ড হওয়ার চাইতে অল আউট হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা অত্যন্ত বেশি। কিন্তু কোনটাই হলো না। অমিমাংসিত ম্যাচটা বয়ে নিয়ে এলো একরাশ হতাশা।
সালটা ২০১৩, বছরের শেষদিক, চলমান ডিসেম্বরের ২২তম দিন। দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ইতিহাস সৃষ্টির দাঁড়প্রান্তে পৌঁছে গিয়েছিল প্রোটিয়ারা। কিন্তু তা আর হতে দিলেন কই ভারতীয় বোলাররা? আচ্ছা শুরু থেকে শুরু করি। একেবারে টস থেকেই করা যাক। না পুরো পাঁচ দিনের ফিরিস্তি নিয়ে আসিনি। সংক্ষিপ্ত করে একটু স্মৃতিচারণ।
টস ভাগ্যটা ভারতের খুব একটা মন্দ নয়। ১৮ ডিসেম্বর ২০১৩ জোহানেসবার্গের সকাল বেলায়ও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ভারত আগে থেকেই পরিকল্পনা সাঁজিয়ে দুই উদ্বোধনি ব্যাটার রণক্ষেত্রের সাজসজ্জা শেষে নেমে পড়লেন ময়দানে।
সূর্য তখন তাঁর প্রখর কিরণ একটু একটু করে ছড়িয়ে দিচ্ছে সমগ্র মাঠজুড়ে। সে যাই হোক বেশ দেখেশুনে সতর্কতার সাথে খেলতে লাগলেন মুরালি বিজয় এবং শিখর ধাওয়ান। ‘স্টেইনগান’ খ্যাত ডেইল স্টেইন আর মরনে মরকেলকে সকাল সকাল উপমহাদেশের বাইরে সামলানো তো আর চাট্টিখানি কথা নয়।
যেখানে বাঘের ভয় সেখানে রাত্রি হয়। সেই স্টেইনের বলেই ইমরান তাহিরকে ক্যাচ দিয়ে ফিরে গেলেন ধাওয়ান। তারপর বিজয়ও চললেন মরকেলের শিকারে পরিণত হয়ে। এবার তো হাল ধরতে হয়। দায়িত্ব নিয়ে নিলেন ভারতের এই সময়ের সেরা ব্যাটার বিরাট কোহলি, সাথে সঙ্গ দিলেন চেতেশ্বর পুজারা।
কিন্তু শতক হাঁকিয়ে দলের প্রয়োজন ঠিকঠাক সামলেছেন কোহলি কিন্তু পুজারা ৯৮ বল খেলে করেছিলেন ২৫রান। তবে সেই সময়ে সেই ৯৮ বল খেলাও ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এরপরে বলার মতো রয়েছে শুধু আজিঙ্কা রাহানের ইনিংস। তিনিও দারুণ দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন। ১৩৭ বলে ৪৭ রানের ইনিংস দক্ষিণ আফ্রিকাকে অপেক্ষা করিয়েছে দ্বিতীয় দিনের।
দ্বিতীয় দিনের প্রথম সেশনে ভারত আর টিকে থাকতে পারলো না। অগ্যতা দক্ষিণ আফ্রিকা নেমে গেলো ব্যাটিং-এ। তবে এর কৃতীত্ব পেতে পারেন দক্ষিণ আফ্রিকান বোলার ভার্নন ফিল্যান্ডারের। তিনি একাই নিয়েছিলেন চারটি গুরুত্বপূর্ণ উইকেট। তো যথারীতি প্রোটিয়া অধিনায়ক গ্রায়েম স্মিথ এলেন ক্রিজে সঙ্গে আলভিরো পিটারসেন।
সকালটা কাটিয়ে দিলেন দু’জন তবে দীর্ঘায়িত হলো না আর এই জুঁটি। প্রথম উইকেট রুপে সাঁজঘরে পিটারসন। তারপর বল খেলে ভারতীয় বোলারদের অপেক্ষার প্রহর দীর্ঘায়িত করা ছাড়া বেশিকিছু করতে পারেননি প্রোটিয়া ব্যাটাররা। সেই ভার্নন ফিল্যান্ডার ও স্মিথের দুই অর্ধশতকে ভারতের থেকে ৩৬ রান কমে থামে প্রোটিয়াদের ইনিংস। ভারত করেছিলো ২৮০।
তারপর খেলার ধরণ কিংবা পিচের ধরণ পুরোপুরি বদলে গেলো। একেবারে খাসা ব্যাটিং পিচে পরিণত হয়ে গেলো জোহানেসবার্গের সেই সেন্টার উইকেট। কিন্তু ভারতের ওপেনিং জুঁটি তাঁদের ইনিংস দীর্ঘায়িত করতে আবার ব্যর্থ। আবার ইনিংসের দায়িত্ব এসে পড়লো পুজারা আর বিরাটের কাঁধে। একেবারে চীনের প্রাচীরের ন্যায় দুইজন ইনিংস সামলানোর পাশাপাশি রানের চাকাও রাখলের সচল। পুজারার ব্যাট থেকে এলো ১৫৩ এবং ৯৬ করলেন বিরাট। নিচের দিকে আর তেমন বলার মতো রান না এলে, প্রোটিয়াদের টার্গেট গিয়ে ঠেকে ৪৫৮তে।
তা মোটামুটি দুষ্কর কিন্তু অসাধ্য নয় এত বড় রান তাড়া করে যেতা। এর আগে অস্টেলিয়ার বিপক্ষে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪১৮ ও একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকাই ৪১৪ রান করে জয় ছিনিয়ে নিয়েছিল। উইন্ডিজরা করেছিল ২০০৩ এ আর প্রোটিয়াদেরটা তার বছর পাঁচেক বাদে। সুতরাং প্রোটিয়ারা টেস্টের পঞ্চম দিনে বড় রান তাড়া করে জেতার দীক্ষা আগেই পেয়েছিল। ২০১৩তে অপেক্ষা ছিলো ক্যারিবিয়ানদের রেকর্ডটা ভেঙে ফেলার।
তা ভারতের বিপক্ষে প্রোটিয়া ব্যাটাররা সেই দূর্ভেদ্য লক্ষ্যটাকে ধরে দেখবার ব্রত নিয়েই নেমেছিলো চতুর্থ ইনিংসে ব্যাট করতে। সূচনাটা বেশ ভাল এক পার্টনারশিপের মধ্য দিয়েই হয়। দলীয় রান যখন শতকের চেয়ে খানিক বেশি তখন প্রথম উইকেট হিসেবে সাঁজঘরে যান গ্রায়েম স্মিথ।
তবে তাঁর ভুলে নয় রান আউটের ফাঁদে পড়ে যেতে হল তাঁর। হাশিম আমলা প্রায় এলেন আর চলে গেলেন। কিন্তু সেই কঠিন পথ পাড়ি দেওয়া ম্যাচে যে জেতা যাবে সেই স্বপ্নকে বড় পর্দায় ফুটিয়ে তোলার কাজটা করলেন ফাফ ডু প্লেসিস ও এবি ডি ভিলিয়ার্স। অন্যদিকে পিটারসন ৭৬ রান করে সেই স্বপ্নের একটা সূচনা করে দিয়ে গিয়েছিলেন।
মানুষ যা ভাবে কিংবা যা নিয়ে স্বপ্ন দেখে তা কি কখনো হয়? হয়না ২০১৩ সালের সেই টেস্টের শেষ দিনের শেষেরদিকে এসে যখন ভিলিয়ার্স ও ফাফ ডু প্লেসিস ফিরে গেলেন স্বপ্নকে বাস্তবে রুপান্তরিত না করেই ঠিক তখন সৃষ্টি হয় শঙ্কার। টেস্ট হেরে যাওয়ার। এত কাছে এসে পরাজয়ে এক স্বাদ পাওয়ার।
অবশেষে ড্র-কেই বেছে নিলো দক্ষিণ আফ্রিকা। দিনের খেলা শেষ করে ৪৫০/৭। মাত্র আটটা রানের দূরত্ব। সেই আট রান তবু সৃষ্টি করে আট আসমান পরিমাণ দূরত্ব। জয় এবং ইতিহাস গড়া জয়ের মাঝে। খুব জানতে ইচ্ছে করে প্রোটিয়াদের কি আজো মনের গহীন কোণ থেকে কোন আক্ষেপ উঁকি দেয় কি না মাঝেসাঝে।
আবার সময়ের পরিক্রমায় এসেছে ডিসেম্বর। আবার ভারত যাচ্ছে দক্ষিণ আফ্রিকায়। ২৬ তারিখ বক্সিং ডে-তে শুরু হবে দুই দলের মধ্যকার তিন ম্যাচ টেস্ট সিরিজের প্রথম টেস্ট। প্রায় এক যুগের বেশি অতিক্রান্ত হওয়া আক্ষেপ ঘোচানোর সুযোগ যদি এবার প্রোটিয়ারা পায় তবে কি তাঁরা সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করবে না? সময়ের কাছে তোলা থাক এই প্রশ্ন।