চারিদিকে শোরগোল – ভারত বিশ্বকাপ জিতে গেছে!

ক্রিকেট নামের খেলাটার সময় আমার প্রথম পরিচয় ছয় কি সাত বছর বয়সে। পাড়ার খেলায় সেই সময়ের দল তৈরি করার একটা মজার নিয়ম ছিল। হয়ত এখনও আছে। ছেলেদের মধ্যে সেরা দুই ক্রিকেটার ক্যাপ্টেন হত। বাকিদের মধ্যে মোটামুটি সমান স্কিলের ছেলেরা জোড়ায় জোড়ায় একটু দূরে গিয়ে দুজন বিখ্যাত মানুষের নাম নিয়ে ক্যাপ্টেনদের কাছে হাজির হত।

‘কৌন লেগা অমিতাভ, কৌন লেগা ধ্রমেন্দ্র?’ – এই ধরনের প্রশ্নের উত্তরের ওপর নির্ভর করত কে কোন দলে যোগ দেবে। ক্যাপ্টেনের যে নাম পছন্দ হত সেই নামের ছেলে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত তার পাশে।

প্রায় আমার মতই আনাড়ি আরও একটা প্লেয়ারের সঙ্গে আমাকে পেয়ার করা হত। সে প্রথমদিনই আমার কাঁধে হাত দিয়ে ফিসফিস করে পরামর্শ দিল, ‘তুই হচ্ছিস কপিল দেব, আমি হব কারসন ঘাউড়ি।‘

আমি দুজনের কাউকেই চিনতাম না। আমাকে যে এই অদ্ভুত খেলাটায় নেওয়া হচ্ছে তাতেই আমি আপ্লুত। সুতরাং রাজি হয়ে যেতাম ‘কপিল দেব’ হতে। কিছুদিন খেলার পর বুঝলাম অপেক্ষাকৃত ভালো প্লেয়াররা ‘কারসন ঘাউড়ি’ নাম নেয়, কমজোরিরা ‘কপিল দেব’।

সালটা ১৯৭৯-৮০। এখন বুঝতে অসুবিধে হয় না কপিল দেবের তুলনায় ঘাউড়ি কেন বেশি জনপ্রিয় ছিল। একে বাঁ হাতি ফাস্ট বোলার যা ক্রিকেটে রেয়ার স্পেসিস, তার ওপর ঘাউড়ির চেহারাও বেশ হিরো সুলভ ছিল। অন্যদিকে কপিল দেব দেখতে তেমন ইম্প্রেসিভ তো ছিলই না, মাঠের মধ্যে ওর হাবভাবের মধ্যেও কেমন যেন একটা গাঁইয়া ভাব। তখনকার দিনে ক্রিকেট মার্জিত, শিক্ষিত মানুষের খেলা হিসেবে চিহ্নিত ছিল, সেখানে কপিলকে একটু বেমানানই লাগত।

ক্রিকেটের সমঝদারেরাও তখন গাভাস্কার বা বিশ্বনাথের মধ্যেই নিজের আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখতেন।

এরপর বেশ কিছুদিন ক্রিকেটের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ছিল না। মধ্যেকার বছরগুলি গুলি-ডাণ্ডা, ঘুড়ি বা কাচের মার্বেলের সঙ্গে কেটেছে। ১৯৮২ সালে বাবার ট্রান্সফার হওয়ায় নতুন টাউনশিপে চলে আসি আমরা। সেখানে আবার ক্রিকেটের সঙ্গে মোলাকাত হল। ততদিনে কপিল দেব নাকি ভারতের  অধিনায়ক হয়েছেন। আর তাঁর নেতৃত্বে ভারত বিশ্বকাপ খেলতে গেছে ইংল্যান্ডে।

তা গেছে তো গেছে – তাতে আমার কী? কিন্তু টুকরো খবর কানে আসতে লাগল। জিম্বাবুয়ের বিরুদ্ধে ১৭৫ রান করে রেকর্ড করেছে কপিল। অবশ্য ‘রেকর্ড’ কথাটার মানে ঠিক বুঝলাম না। রেকর্ড প্লেয়ারের সঙ্গে কোন সম্পর্ক আছে হয়ত, মনে মনে ভাবলাম।

আবার কানে এল সবাইকে অবাক করে কপিলের ভারত নাকি বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেছে। কিন্তু আর চান্স নেই। ওয়েস্ট ইন্ডিজ নামের একটা দলের এক একটা প্লেয়ার নাকি আমাদের দশটার সমান।

সেদিন সন্ধেবেলায় পৃথিবীর ম্যাপ নিয়ে বসলাম। জিম্বাবওয়েকে খুঁজে পেলেও ওয়েস্ট ইন্ডিজকে কিছুতেই খুঁজে পেলাম না। বাড়ির অভিভাবকদের বলেও লাভ হোল না। তাদের অবশ্য দেশ খোঁজার চেয়ে অনেক বেশি জরুরী কাজ আছে।

একদিন হঠাৎ চারিদিকে বিশাল শোরগোল – ভারত বিশ্বকাপ জিতে গেছে। খবরের কাগজের প্রথম পাতায় বিশ্বকাপ হাতে কপিলের ছবি, পেছনের পাতায় লয়েডের মাঠের ঘাসে মুখ দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকার ছবি।

আর ইস্কুলে আচমকা কোথা থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি ক্রিকেটের এক্সপার্ট গজিয়ে উঠল। ফাইনালে কপিলদেব নাকি চল্লিশ গজ ছুটে তারপর ‘ড্রাইভ’ দিয়ে ভিভ রিচার্ডসের ক্যাচ ধরেছে। মদনলাল নাকি বিশ্বকাপে যাওয়ার আগে নিজের ডান হাতের আঙুল বল গ্রিপ করার ভঙ্গিতে ‘সেট’ করিয়ে নিয়ে গেছিল।

শ্রীকান্তের স্কয়ার কাটের চোটে নাকি বাউন্ডারির বাইরের এক কুকুর মারা গেছে। মহিন্দার অমরনাথ নাকি স্পিডে মার্শালকেও ছাড়িয়ে গেছে। সৈয়দ কিরমানি কুড়ি গজ লাফ মেরে ক্যাচ ধরে কাকে যেন আউট করেছে। মোদ্দা কথা, এক ধাক্কায় ক্রিকেট নামের খেলাটা বুদ্ধিজীবীদের কবল থেকে মুক্ত হয়ে জনসাধারণের হাতে চলে এল।

আরও একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম – আমাদের পাড়ার ক্রিকেটে আর আমাকে কেউ ‘কপিল দেব’ নাম দিতে রাজি হচ্ছে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link